বলতেন নারীর প্রগতির কথা

নারীর সার্বিক উন্নতি ও বিকাশ সারদাদেবীর ভাবনায় ছিল। নারীর স্বাধীনতা আদায়ে পুরুষের প্রয়োজন নেই। সে নিজে তাঁর অধিকার আদায় করে নিতে শিখুক—এটাই তাঁর অন্যতম বক্তব্য ছিল। তাই চেয়েছেন নারীরা শিক্ষিত হোক। লিখছেন সৌমেন রক্ষিত গ্রাম্য সরলতায় পূর্ণ ছিল তাঁর হৃদয়, তেমনই শহরের জীবনযাত্রা ও জাতীয় ঘটনাবলি সম্পর্কেও তিনি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল ছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:৪৬
Share:

শ্রীশ্রী সারদাদেবী। ফাইল চিত্র

বাঁকুড়ার জয়রামবাটীতে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরীদেবীর বাড়িতে যে সময়ে শ্রীশ্রী সারদাদেবীর জন্ম (১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ) হয়, সে সময়ে কলকাতায় চলেছে নারীমুক্তি ও নারী প্রগতির উদ্দেশ্যে একাধিক সংস্কার। উনিশ শতকের প্রথম থেকেই এক দল সংস্কারকামী মানুষের পরিচয় মেলে বঙ্গের নবজাগরণের ইতিহাসে। ডেভিড হেয়ার ও তাঁর সঙ্গে এ দেশীয় মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় একে একে নারী-লাঞ্ছনার চিত্রগুলি বদলাতে শুরু করে। এ জন্য তাঁদের কম পরিশ্রম করতে হয়নি।

Advertisement

রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা নিবারণ বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন পাশ ও বহু বিবাহ রদ করার কথা বহুল প্রচারিত। এ ছাড়াও সমাজের অগণিত কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি রোধে বহু হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। কেবল সমাজ নয়—ধর্মীয় ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও এই সংস্কার হয়েছিল।

বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম ও বড় হওয়া সারদাদেবীর উত্তর-জীবন কাটে কলকাতা ও জয়রামবাটীতে। ফলে এক দিকে যেমন গ্রাম্য সরলতায় পূর্ণ ছিল তাঁর হৃদয়, তেমনই শহরের জীবনযাত্রা ও জাতীয় ঘটনাবলি সম্পর্কেও তিনি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল ছিলেন। সংসারের যাবতীয় কাজের সঙ্গে তাই তাঁকে দেখা যায় জাতীয় স্তরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভক্ত-শিষ্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে। তাঁর কাছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে যেমন সকল মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল, তেমন আসতেন সে যুগের বহু বিপ্লবীও। ফলে জীবন ও জাতীয়তাবোধে সারদাদেবী অনেক বেশি আধুনিক ছিলেন।

Advertisement

এই আধুনিকতার সোপান বেয়েই তাঁর মনন ও মানসিকতা প্রবাহিত হয়েছে প্রগতির খাতে। তখন স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন সে ভাবে ছিল না। সারদাদেবীও খুব বেশি পড়াশোনা করে উঠতে পারেননি। রাসসুন্দরীদেবী তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সেকালে মেয়েছেলের বিদ্যাশিক্ষা ভারী মন্দ-কর্ম বলিয়া লোকের মনে বিশ্বাস ছিল।” কিন্তু সারদাদেবী মনে করতেন, স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার না ঘটলে স্ত্রীজাতি নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তিনি নিজে চিঠি লিখতেন না ঠিকই, কিন্তু পড়তে পারতেন ভাল ভাবেই। তিনি ভাল ভাবে পড়তে শিখেছিলেন বা পড়তেন বিয়ের পরে, দক্ষিণেশ্বরে ও শ্যামপুকুরে থাকাকালীন। স্ত্রীজাতিকে স্বাবলম্বী হতে হবে—এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি মেয়েদের পড়াশোনা করতে বলতেন। রাধু, মাকু প্রমুখ ভাইঝিদের তিনি নিজে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বিবাহিতা রাধুকে তিনি উদ্বোধনের কাছে একটি স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করে দেন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণকেও গুরুত্ব দিতেন। নিবেদিতার স্কুল খুবই পছন্দ করতেন। কারণ, সেখানে যেমন পড়াশোনা হত, তেমন শেখানো হত হাতের কাজও।

সে যুগে প্রচলিত অন্যতম একটি প্রথা ছিল বাল্যবিবাহ। তবে শুধু সে সময়ে নয়—এখনও নাবালিকা বিয়ের খবর প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নেয়। ঋতুমতী কন্যা গৃহে রাখা পাপ। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘উদ্বাহতত্ত্বে’ এই বিধানই দিয়েছেন, যা বঙ্গে চিরসত্য বলে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় প্রচলিত ‘বিবাহ-আইনে’ নারীর ক্ষেত্রে সহবাসে সম্মতির সর্বনিম্ন বয়স দশ ঠিক করা হয়। ১৮৭২-এ ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে পাশ হওয়া বিবাহ আইনে স্থির হয়, বিয়ের জন্য ছেলের বয়স হতে হবে ন্যূনতম আঠারো আর মেয়ের চোদ্দো। সারদাদেবীর নিজের কম বয়সে বিয়ে হলেও তিনি বাল্যবিবাহ প্রথার বিরোধী ছিলেন। রাধুর কম বয়সে বিয়ে হওয়াকে তার যন্ত্রণার কারণ বলে দুঃখপ্রকাশ করতেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি এক বার বলেছিলেন, “আহা, তারা (দু মাদ্রাজী কুড়ি-বাইশ বছর বয়সী তরুণী) কেমন সব কাজকর্ম শিখেছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আট বছরের হতে না হতেই বলে, ‘পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও!” সারদাদেবীর মেজো ভাই কালীকুমার তাঁর বড় ছেলের তেরো আর ছোট ছেলে রাধারমণের এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়। ছোট ছেলের বিয়ের পত্র পেয়ে তিনি খেদোক্তি করেন, “ছোট ছোট ছেলের বিয়ে দিচ্ছে—আমার কাছে (মত) আদায় করে নিচ্ছে। আখেরে যে কষ্ট পাবে তা জানে না।”

শুধু শিক্ষার অধিকার বা বাল্যবিবাহ রোধ নয়—সঠিক প্রেক্ষিতে মেয়েদের ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাস গ্রহণ এবং শাস্ত্রপাঠ ও পূজার্চনার অধিকারের কথাও জানিয়েছেন তিনি। ঋগ্বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী সময়ে ‘ব্রহ্মবাদিন’ নামে এক শ্রেণির স্ত্রীজাতির কথা জানা যায়, যাঁরা সন্ন্যাস জীবন যাপন করতেন এবং ধর্ম ও দর্শন চর্চা করতেন। মহীশূরের নারায়ণ আয়েঙ্গারের কন্যা ব্রহ্মচারিণী হতে চাইলে সারদাদেবী, স্বামী সারদানন্দকে দিয়ে এই মর্মে চিঠি লিখিয়েছিলেন যে, মেয়েদেরও সেই অধিকার আছে। এ কারণেই গৌরী-মার আশ্রমের ব্রহ্মচারিণীরা ও নিবেদিতার স্কুলের ত্যাগী মেয়েরা সারদাদেবীর এত প্রিয় ছিল।

নারীর সার্বিক উন্নতি ও বিকাশ সারদাদেবীর ভাবনায় ছিল। নারীর স্বাধীনতা আদায়ে পুরুষের প্রয়োজন নেই। সে নিজে তাঁর অধিকার আদায় করে নিতে শিখুক—এটাই তাঁর অন্যতম বক্তব্য ছিল। আর সে কারণেই বারেবারে চেয়েছেন নারীরা শিক্ষিত হোক। কারণ, শিক্ষা না পেলে আত্মশক্তি বাড়ে না। সারদাদেবী নিজে স্ত্রী-মঠ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন এবং বলতেন, স্ত্রী-মঠে নারীরাই হবে প্রধান ও পরিচালক। দুর্গাপুরীদেবীর ‘সারদা-রামকৃষ্ণ’ গ্রন্থে আছে, সারদাদেবী এক বার এক ভক্তকে বলেন, “সন্তানদের অনেককে তো দেখি নিজেদের ভুলত্রুটি অপরাধের ইয়ত্তা নেই, তবু তারা চায় বউ-ঝিরা তাদের কাছে নত হয়ে থাকুক। এই অন্যায়ের ফলে যে দিন আসছে, মেয়েরা আর পৃথিবীর মতো সইবে না।” যে সারদাদেবী সহ্যের কথা বলতেন, সেই তিনিই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে গিয়েছেন। প্রায় একশো বছর আগের প্রেক্ষাপট থেকে আজকের সময়ে পদার্পণ করলে তার হাজারো নমুনা পাওয়া যায়।

সারদাদেবী অন্য সংস্কারকদের মতো একা বা দল গঠন করে রাস্তায় নেমে নারীমুক্তি আন্দোলন করেননি ঠিকই, কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন কী ভাবে ব্যক্তিজীবন সুন্দর করে তৈরি করা সম্ভব এবং সেই সঙ্গে সম্ভব নারীর সার্বিক উন্নতিও।

তথ্যসূত্র: ‘শ্রীমা সারদা দেবী’, স্বামী গম্ভীরানন্দ

লেখক সহশিক্ষক, সিমলাপাল মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement