Rural Ecosystem

ঠিকমতো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রয়োজন নজরদারিরও

গত কয়েক দশকে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ বাস্তুতন্ত্রে। তার জেরে বিপন্ন হয়েছে বর্জ্য পদার্থের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও। এর জেরে বেড়েছে দূষণের সমস্যাও। ভূপ্রকৃতিগত ভাবে পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা ব্লকের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে যথাক্রমে অজয় নদ ও দামোদর নদ

Advertisement

বিপ্লব ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২০ ০৬:০৯
Share:

গোপালপুরের এই বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রটি চালু হয়নি।

পরিবেশবিদদের দাবি, গত কয়েক দশকে নগরায়নের হাত ধরে ক্রমশ বদলে গিয়েছে গ্রামীণ এলাকাগুলির আর্থ সামাজিক চেহারা। তারই সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তির হাত ধরে একটা বড় ধরনের বাঁকবদল এসেছে চাষ, প্রাণিপালন-সহ নানা ক্ষেত্রে। এক দিকে, যেমন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামাল দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষ বা প্রাণিপালন মানুষের খাদ্যসঙ্কট মিটিয়েছে, তেমনই তৈরি করেছে কিছু সমস্যাও। পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলার নানা প্রান্তের সামগ্রিক চিত্র আলোচনা করলে দেখা যাবে, আগেকার দিনে জেলার নানা প্রান্তে ছিল ভাগাড় নামে একটি এলাকা। সেখানে গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তের আবর্জনা ফেলা হত। মৃত প্রাণীর দেহ খেয়ে বেঁচে থাকত শকুন, হাড়গিলের মতো নানা প্রজাতির মৃতভোজী প্রাণী। কিন্তু বর্তমানে ভাগাড় কমে যাওয়া, প্রাণিপালনের ক্ষেত্রে নানা রাসায়নিক ওষুধের উপরে নির্ভরতার কারণে ক্রমশ বিপন্ন হয়েছে শকুন, হাড়গিলের মতো প্রাণীরা। ফলে গত কয়েক দশকে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে গ্রামীণ বাস্তুতন্ত্রে। তার জেরে বিপন্ন হয়েছে বর্জ্য পদার্থের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও। এর জেরে বেড়েছে দূষণের সমস্যাও। পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা ব্লকের নিরিখে এই দূষণের সমস্যার গুরুত্বকে বিচার করা যাক।

Advertisement

ভূপ্রকৃতিগত ভাবে পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা ব্লকের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে যথাক্রমে অজয় নদ ও দামোদর নদ। ব্লকের নানা স্থান জুড়ে রয়েছে ঘন বিস্তৃত জঙ্গলও। ব্লকের বেশিরভাগ গ্রাম কৃষিপ্রধান এলাকা হলেও পানাগড়ের মতো বহু শিল্পতালুকও রয়েছে এই ব্লকে। কাঁকসার গোপালপুর, বামুনাড়া, বাঁশকোপা শিল্পতালুকে রয়েছে বহু ছোটবড় কারখানা। এলাকার বহু মানুষই সেই সব কারখানায় কাজ করেন। ফলে এই এলাকাগুলিতে গড়ে উঠেছে এক নতুন ধরনের বাস্তুতন্ত্র। যেখানে এত দিনের প্রচলিত বর্জ্য পদার্থের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এক নতুন বর্জ্য, যার সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি নির্ভর এই এলাকার বাস্তুতন্ত্রের আগে পরিচিতি ছিল না। শিল্পজাত রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থের ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করা বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে বর্তমানে কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শিল্পজাত বর্জ্য রাসায়নিক মিশ্রিত জলশোধন করে এই এলাকার নদীগুলিতে ফেলার বন্দোবস্ত হয়েছে। এলাকাবাসী জানান, দুর্গাপুর শহর লাগোয়া আড়া, বামুনাড়ার মতো এলাকায় জনবসতিও অনেকটাই বেড়েছে। ফলে বাড়ছে দৈনন্দিন জীবনে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থও।

কাঁকসার আড়া এলাকায় এ ভাবেই আবর্জনা পড়ে থাকে।

Advertisement

এলাকাবাসী জানান, কাঁকসার গোপালপুর পঞ্চায়েতের গোপালপুর, বামুনাড়া-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় একের পর এক বহুতল আবাসন গড়ে উঠছে। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এলাকার আবর্জনা সংগ্রহ করার মতো কোনও পরিষেবা মেলে না। ফলে অনেকেই নিজের অর্থ খরচ করে আবর্জনা ফেলার ব্যবস্থা করেন। এলাকার বাসিন্দা অরুণ মণ্ডল, তুহিন ঘোষেরা বলেন, ‘‘যত্রতত্র আবর্জনা পড়ে থাকায় এলাকা দূষিত হচ্ছে। এ বিষয়ে পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ করা প্রয়োজন।’’ গোপালপুর পঞ্চায়েত সূত্রে খবর, এলাকার সমস্যার কথা মাথায় রেখে বছর দুয়েক আগে গোপালপুর ও বাঁদড়ার মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় বাইশ লক্ষ টাকা খরচ করে একটি বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, আইনি জটিলতায় সেই কেন্দ্র আর চালু করা যায়নি। বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। পঞ্চায়েতের এক সদস্য জানান, আর্থিক জটিলতার কারণে নতুন করে কোথাও কেন্দ্র গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। ফলে এখন আদালতের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন তাঁরা।

মলানদিঘি পঞ্চায়েতের মতো এলাকাতেও আবর্জনা সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আড়া, কালীনগরের মতো জায়গায় যে সব আবাসন তৈরি হয়েছে, সেখানকার বাসিন্দারা জানান, দুর্গাপুর ঘেঁষা জায়গা হলেও, এখানকার এলাকাগুলিতে ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবা মেলে না। ফলে আবর্জনা ফেলার জন্য ফাঁকা জায়গাকেই বেছে নিয়েছেন এলাকাবাসী। বাসিন্দারা জানান, এলাকার বিভিন্ন পরিত্যক্ত ফাঁকা স্থানগুলিতে আবর্জনার স্তূপ তৈরি হতে থাকায় দূষিত হচ্ছে এলাকাও। দুর্গন্ধের জেরে টেকা দায় হয়ে উঠছে। মলানদিঘি পঞ্চায়েত সূত্রে খবর, ২০১৬ সালে রূপগঞ্জ গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময় গ্রামবাসীরা দূষণের কথা ভেবে ওই জায়গায় কেন্দ্র গড়ে তুলতে রাজি হননি। পরে কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যায়নি, ফলে সমস্যা মিটতেই চাইছে না।

পানাগড়ের মতো বাজার এলাকায় বর্জ্য সমস্যার ছবিটা আবার আর এক রকম। এলাকাবাসীরা জানান, পানাগড় বাইপাস তৈরির আগে পানাগড়ের মধ্যে দিয়েই গিয়েছিল দু’নম্বর জাতীয় সড়ক। প্রায় তিন কিলোমিটার এই রাস্তার দু’ধারে গড়ে উঠেছে গাড়ির যন্ত্রাংশ কেনাবেচার বিশাল বাজার। তা ছাড়া কাঁকসা ব্লকের মূল বাণিজ্যকেন্দ্রও পানাগড়। ফলে ব্লকের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজনের যাতায়াত লেগেই থাকে। বর্তমানে পানাগড়ে বেশ কয়েকটি বহুতল আবাসন তৈরি হয়েছে। পানাগড় বাজার এলাকা ও অফিসপাড়া, শর্মাপাড়া, খাটালপাড়া, রেলপাড়, সারদাপল্লি, নতুনপাড়া, ট্যাঙ্কিতলার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতে বর্জ্য সমস্যা দিনে দিনে বাড়ছে বলে জানান এলাকাবাসী। এলাকার বাসিন্দারা জানান, এলাকায় কোনও বর্জ্য ফেলার জায়গা না থাকায় যত্রতত্র আবর্জনা পড়ে থাকছে।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাস্তার ধারে বা ফাঁকা মাঠে বর্জ্য ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আবর্জনার কারণে ক্রমশ দূষিত হচ্ছে এলাকার পুকুরগুলিও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গ্রামীণ এলাকার জলাশয়গুলিতে দিনের পর দিন নোংরা ফেলার কারণে সেগুলির অধিকাংশই বুজে যেতে বসেছে। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এতে এক দিকে যেমন জলাশয় ও তার লাগোয়া বাস্তুতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সঙ্গে সঙ্গে বিপত্তি দেখা দিতে পারে অগ্নিকাণ্ডের মোকাবিলার মতো কাজেও। কাঁকসার সুভাষপল্লি এলাকার পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে পানাগড় বাইপাস। ২০১৬ সালে বাইপাস তৈরির পর থেকে এই এলাকায় অনেকে বসতিস্থাপন করছেন। এখানে আবার রাস্তার ধারে প্লাস্টিক-সহ নানা আবর্জনা ফেলার কারণে ক্রমশ মজে যেতে বসেছে নিকাশি নালাগুলি। ফলে এলাকা যেমন অল্প বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ছে তেমনই বদ্ধ জলে বাড়ছে মশা, মাছির উপদ্রবও। আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে মশা, মাছি বাহিত নানা রোগের ছড়িয়ে পড়া নিয়েও।

পরিবেশবিদদের দাবি, গোটা এলাকাজুড়ে এই বর্জ্য সমস্যা মোকাবিলার জন্য এক দিকে, যেমন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র তৈরি জরুরি তেমনই দরকার নজরদারিরও। তারই সঙ্গে সঙ্গে পুকুরগুলিকে মাছ চাষের মতো নানা কাজে ব্যবহার করলে সেগুলির কদরও বাড়বে বলে আশা তাঁদের। এতে সাধারণ মানুষ নিজেরাই সচেতন হয়ে এগুলির গুরুত্ব বুঝে তার দেখভালে উদ্যোগী হবেন বলে আশা করছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁদের আরও দাবি, এলাকার সব জায়গায় ফি-দিন বাড়ি বাড়ি বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহের পরিকাঠামো তৈরির দিকেও নজর দেওয়া দরকার, তা না হলে কিন্তু বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। এ বিষয়ে বিডিও (কাঁকসা) সুদীপ্ত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমরা নানা ভাবে চেষ্টা করছি সমস্যা মেটানোর। সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতগুলির সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement