জোটের কাঁটার জ্বালা হইতে তবে বিজেপিও বাঁচিল না। এনডিএ-র তৃতীয় বৃহত্তম জোটসঙ্গী তেলুগু দেশম পার্টির দুই মন্ত্রী পদত্যাগ করিবার নয় দিন পরে টিডিপি এনডিএ জোট হইতে পুরাপুরি বাহির হইয়া আসিল ও নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনিতে উদ্যোগী। বিজেপি হয়তো অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়িবে না, কিন্তু সংসদে একটি অপ্রত্যাশিত ও তিক্ত পরিস্থিতির মধ্যে পড়িল অবশ্যই। একে তো কংগ্রেস, বাম-সহ বিরোধী দলগুলি বিক্ষুব্ধ টিডিপি-র সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া অনাস্থা প্রস্তাবে যোগ দিতে চলিয়াছে। তদুপরি, অনাস্থা প্রস্তাব পেশ হইবার আগে যেহেতু বিধিসম্মত সংসদীয় বিতর্ক হইবার কথা, সেই বিতর্কে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী ও বিক্ষুব্ধদের সকল অভিযোগ সুসংহত ভাবে ঘোষণা করিবার সুযোগও মিলিতে চলিয়াছে। বিজেপির মতে অবশ্য, ভালই হইল, তাহাদেরও স্বপক্ষ সমর্থনের উত্তম সুযোগ হাতের নাগালে আসিল। তবে, নিশ্চিত বলা যায়, সরকারের তরফে ইহা কোনও আনন্দময় অভিজ্ঞতা হইতে পারে না। শিবসেনার উদাহরণটিই যথেষ্ট। সংখ্যায় সর্ববৃহৎ জোটসঙ্গী শিবসেনা আসন্ন অনাস্থায় শামিল না হইয়া নিরপেক্ষ থাকিলেও বিজেপির অন্যায় আগ্রাসন-প্রবণতা ও স্পর্ধিত অসহযোগিতা লইয়া তাহাদের মন্তব্য বিজেপিকে অসুবিধায় ফেলিবে। বাস্তবিক, উত্তরপ্রদেশ আর বিহারে নির্বাচনের ফলাফলের পর পরই টিডিপির দৌলতে সংসদে এখন সরকারবিরোধিতার যে চাপ, সরকার তাহাতে আপাতত অত্যন্ত রক্ষণশীল মেজাজে, ২০১৪’র পর এই প্রথম।
অন্ধ্রপ্রদেশের বিশেষ মর্যাদার দাবিতে টিডিপি-র অনাস্থা প্রস্তাব। অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী ও টিডিপি প্রধান চন্দ্রবাবু নায়ডুর ভাষায়, ইহা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অন্ধ্রবাসীর ধর্মযুদ্ধ। মহাকাব্যিক অলঙ্কারটির পিছনে রাজনৈতিক হিসাবের অঙ্ক স্পষ্ট। এই দাবিতেই ওয়াইএসআর কংগ্রেসের তরফে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক দিন আগেই অনাস্থা প্রস্তাব আসিবার পরই টিডিপি-র রাজনৈতিক বাধ্যতা তৈরি হইয়াছে, রাজ্যে নিজেদের রাজনীতির সম্মান রাখিবার জন্য কেন্দ্রে অনাস্থার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগই একমাত্র পথ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই শর্তেই তাঁহারা এনডিএ জোটে যোগ দিয়াছিলেন, সুতরাং শর্ত পূরণ না হইলে জোট অর্থহীন— বিজেপি সভাপতিকে লেখা চিঠিতে নায়ডুর মন্তব্য।
অন্ধ্রের মানুষের নিকট দায়বদ্ধতা দিয়া যেমন টিডিপির কেন্দ্রীয় কার্যক্রম নির্ধারিত হইতেছে তাহাই বলিয়া দেয়, কী ভাবে প্রাদেশিক দলগুলির মাধ্যমে প্রাদেশিক রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দায়গুলি কেন্দ্রীয় জোট চালাইবার অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইতে পারে। আজ বিজেপি ইহার ভুক্তভোগী, কাল অন্য কোনও কেন্দ্রীয় সরকার একই সঙ্কটের মুখে পড়িতে পারে। ইহা কেন্দ্রীয় সংসদীয় কার্যক্রমের মধ্যে আমূল বিদ্ধ প্রাদেশিক রাজনীতির কাঁটা। সরকার চালাইতে হইলে যে কোনও দলকেই প্রাদেশিক দলগুলির প্রাদেশিক রাজনীতির বাধ্যতাগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া ছাড়া গতি নাই, প্রাদেশিক দলগুলির নিকট কেন্দ্রীয় সরকারের অবনত হওয়া ছাড়াও হয়তো গতি নাই। ঠিক যেমন, এই মুহূর্তে অনাস্থা প্রস্তাব বিষয়ে তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে-র (লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল) অবস্থান, প্রস্তাবে তাহারা কোন পক্ষ লইবে তাহা নির্ভর করিতেছে কেন্দ্রীয় সরকার কাবেরী ম্যানেজমেন্ট বোর্ড তৈরি করিয়া কাবেরী নদীর জলবণ্টন বিতর্কে দ্রুত পদক্ষেপ করে কি না, তাহার উপর। অর্থাৎ ইহা একটি গভীরতর সমস্যা। কেবল অনাস্থা প্রস্তাবটিকে পরাজিত করিলেই এই কেন্দ্র-রাজ্য স্বার্থসংঘাত মিটিয়া সচল রাজনীতি তৈরি হওয়ার আশা করা ছেলেমানুষি। ইহা ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি মৌলিক সংঘাত। নানা সময়ে নূতন কাঁটার রূপে ইহা ফিরিয়া আসিবে।