আমরা শুধু সেই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে তথ্যচিত্র করার কথা ভেবেছি যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে তথাকথিত আর্ট ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত বা সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ছবিতে যাঁদের প্রতিভা বিকশিত হতে দেখা গেছে— কথাগুলো লিখেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (অভিনয়ের ইতিহাস হারিয়ে যাবে কেন)। তাঁর আক্ষেপ ছিল, এখানে অভিনয়ের ইতিহাসকে নথিবদ্ধ করে রাখার প্রয়াস দেখাই যায় না প্রায়।
‘অভিনয়ের’ ইতিহাস— এই শব্দটাই লিখেছিলেন সৌমিত্র। ‘অভিনেতার’ ইতিহাস লেখেননি। কারণ, শুধু ব্যক্তিগত অভিনয়প্রতিভা নয়, সৌমিত্র বোঝাতে চাইছিলেন অভিনয়শৈলীর বিবর্তনের ইতিহাসের কথা। বঙ্গীয় চিত্রাভিনয়ই ছিল এই লেখার ক্ষেত্রে তাঁর আলোচ্য পরিসর। শুধু এই এক বার নয়। মঞ্চ ও পর্দায় তাঁর ‘অগ্রপথিক’দের কথা এবং তাঁর সহপথিকদের কথা বার বার লিখেছেন সৌমিত্র। শুধুমাত্র স্মৃতিতর্পণে আটকে না থেকে বার বারই তাঁর লেখা ছুঁয়ে গিয়েছে অভিনয়ের ইতিহাসকে। তিনি যখনই অভিনেতৃদের সম্পর্কে লিখেছেন, সেই অভিনেতৃর অভিনয়-বৈশিষ্ট্য এবং অভিনয়-ঐতিহ্য সম্পর্কে সৌমিত্রর পর্যবেক্ষণ ঠিকরে বেরিয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই তিনি বঙ্গীয় অভিনয়-ধারার পরিপ্রেক্ষিতে সেই অভিনেতৃকে কী ভাবে পড়তে হবে, তার দিশা দিতে দিতে এগিয়েছেন। তাঁর প্রয়াণের প্রাথমিক শোকসন্তাপ কাটিয়ে ওঠার পরে ‘অভিনয়ের ইতিহাস’ সংরক্ষণের কাজটিতে মন দিলে সৌমিত্রর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা অর্পিত হতে পারে।
আমাদের এখানে আজ অবধি অভিনয়শৈলীর পাঠ ও বিশ্লেষণ তার প্রাপ্য গুরুত্ব পায়নি। চিত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি সত্য। ওই ছবিতে সেই অভিনেতা কী ফাটাফাটি অভিনয় করেছিলেন, এই জাতীয় ভাবোচ্ছ্বাস আমাদের করতলগত। আর একটু এগোলে ‘যথাযথ’, ‘চরিত্রোপযোগী’, ‘হৃদয়স্পর্শী’ ইত্যাকার সারশূন্য বিশেষণও কম পড়ে না। কিন্তু কোন প্রকরণে সে অভিনয় সাধিত হল, সেই প্রকরণের শিকড় কোন অভিনয়ধারা থেকে উৎসারিত, কোথায় বা সে জারিত হয়েছে অপরাপর শৈলীর সংশ্লেষে, সে ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ বড় কম। কোনও অভিনেতৃর কথা লিখতে হলে বড়জোর তিনি অমুকের শিষ্য আর তমুকের দ্বারা প্রভাবিত-র বাইরে আর কিছু যোগ করার কথা তাই সচরাচর আমাদের মনে আসে না। সেই শিষ্যত্ব এবং প্রভাবের স্বরূপটি কী, সে বিষয়ে আর তেমন কোনও বিশদ আলোচনা দেখা যায় না। সৌমিত্রর লেখায় কিন্তু এর অতি জরুরি মুখবন্ধটি করা আছে। সৌমিত্র দেখিয়ে গিয়েছেন, বঙ্গীয় অভিনয়-ঐতিহ্যে ছিল মূলত তিনটি ঘরানা। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বভাববাদী ধারাটি বয়ে গিয়েছিল অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি থেকে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, যোগেশ চৌধুরী হয়ে তুলসী চক্রবর্তী, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভা দেবী, মলিনা দেবীদের মধ্য দিয়ে।
বাংলার অভিনেতৃবর্গকে নিয়ে সৌমিত্রর লেখালিখি অহরহ আশ্চর্য সব মণিমুক্তোর সন্ধান দেয়। প্রতি পদে বোঝা যায়, কী নিবিড় এবং ব্যাপ্ত তাঁর দৃষ্টি, যেখানে ধরা পড়ে, অসিতবরণ এবং জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের হাঁটা ছিল সবচেয়ে সুন্দর! তিনি মনে করিয়ে দেন, কালী বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু ব্যতিক্রমী অভিনেতা নন, তাঁর দেহ-সৌষ্ঠবও ছিল অতুলনীয়! সৌমিত্রর লেখায়, কথনে বার বার উচ্চারিত হয় বাংলার চরিত্রাভিনেতৃদের কথা। তুলসী চক্রবর্তী এবং কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলেন শতমুখে। সেই সঙ্গে বলেন তুলনামূলক ভাবে কম আলোচিত মুখগুলির কথা। সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতায় যেমন সবিস্তার বলেছিলেন গোবিন্দ চক্রবর্তীর অভিনয় নিয়ে। রাজলক্ষ্মী দেবীর কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘বর্তমান প্রজন্মের দর্শক বা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রাজলক্ষ্মী দেবীর নাম প্রায় জানেন না। এই না জানাটা তাঁদের কোনও অপরাধ নয়, কিন্তু তাঁদের না জানানো আমাদের মধ্যে কারও না কারও অমার্জনীয় অপরাধ।’’
আবার এই সৌমিত্রই মনে করিয়ে দেন, বাঙালি উত্তমকুমার বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভেসেছে ঠিকই, কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রেও অভিনয়-রীতির বিশ্লেষণ সে ভাবে হয়নি। বস্তুত, উত্তমের অভিনয়ের জোরের জায়গাগুলো সৌমিত্রর লেখায় যে ভাবে চিহ্নিত হয়েছে, তেমন অন্যত্র কমই আছে। অভিনয়কে যে একটা পরম্পরার মধ্যে গ্রথিত করে দেখা দরকার এবং পরম্পরাকে যে তার স্থানিক এবং কালিক প্রেক্ষিতের নিক্তিতে বিশ্লেষণ করা দরকার— এই চর্চাটাই এখনও বাংলায় খুব পোক্ত হয়নি। চলচ্চিত্রাভিনয়ের আলোচনায় তার উপস্থিতি আরও কম। সৌমিত্র লিখেছিলেন, কমেডি, ট্র্যাজেডি বা রোম্যান্টিক অভিনয়ের ধরনধারণ কী ভাবে বদলেছে, তা অবশ্যই তথ্যচিত্রের আকারে ধরে রাখা উচিত। আরও এক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, তাতে অভিনয় প্রকরণের বিবর্তন তো ধরা পড়বেই, সেই সঙ্গে মূর্ত হয়ে উঠবে সামাজিক আচার-আচরণের বাঁক বদলও। এ দুটো আদতে বিচ্ছিন্নও নয়। সুঅভিনয় তার অবয়বেই নিজ সময়চিহ্নগুলিকে বহন করে। রেণুকা রায়ের চল্লিশের দশকের অভিনয় আর ষাটের দশকের অভিনয় কত আলাদা, সেটা চোখে পড়ার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হয় না।
বরং, চলচ্চিত্রাভিনয় যে হেতু সংরক্ষণযোগ্য, বার বারই তার কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আছে। এবং আছে বলেই চলচ্চিত্রাভিনয়ের পাঠে অভিনয়নৈপুণ্যের পাশাপাশি আরও অনেক কিছু অবলোকন এবং পর্যবেক্ষণেরও সুযোগ আছে। শরীরের ভাষা এবং বাগ্ভঙ্গি— এর কোনওটাই ইতিহাস-ভূগোলবিযুক্ত নয়। যেমন ধরা যাক, কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ছিছিক্কারের রূপটি কেমন হবে, তা কিন্তু সংস্কৃতি-নির্দিষ্ট। সেটা শুধু ‘ছি ছি’ বা তার ভাষান্তর নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশভঙ্গি, যা স্থান এবং কালভেদে বদলে যায়। আবার পাশ্চাত্য সমাজে কাঁধ ঝাঁকিয়ে কথা বলার রেওয়াজ খুবই প্রচলিত। অথচ সেটাই এখানে বয়োজ্যেষ্ঠের সামনে করলে তা অভব্যতার পরিচয়। আবার ‘অভব্যতা’র সংজ্ঞাও স্থাণু নয়। এক কালে শ্বশুর-ভাশুরের সামনে মাথায় ঘোমটা না দেওয়াটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ত। এখন সে রীতি আর নেই বললেই চলে। যে অনায়াস ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তখনকার মেয়ে-বৌরা কাজটি করে ফেলতেন, সেটা দেখতে হলে পুরনো বাংলা ছবির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে যে হেতু একটি সময়কালকে তার রূপ এবং রসসমেত ধরে রাখা যায়, ফলে ভবিষ্যতের কাছে তা এমন বহুবিধ আকরের সম্ভার হিসেবে কাজ করতে পারে।
এই সূত্র ধরে এ-ও ভেবে দেখা যেতে পারে, অভিনয়ের পাঠ ও বিশ্লেষণে কোনও অভিন্ন মাপকাঠি থাকা সম্ভব কি না আদৌ। এ কথা বলার অর্থ অভিনয়কলার সর্বজনীন আবেদনকে অস্বীকার করা নয়। কিন্তু অভিনয়ের বহু সাংস্কৃতিক দ্যোতনা যে সেই নির্দিষ্ট সংস্কৃতি-জগতের অন্তর্ভুক্ত না হলে বোঝা যায় না, এই সত্যটা মাথায় রেখে দেওয়া। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলার রসগ্রহণের ক্ষেত্রেও সার্বজনিকতার পাশাপাশি, কিছু নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ‘কোড’ থেকেই যায়, যা সকলের অধিগম্য নয়। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও সে কথা ঠিক।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ‘নায়ক’ ছবির একটা দৃশ্যে শর্মিলা ঠাকুর তাঁর দুই সহযাত্রীকে টফি এগিয়ে দিচ্ছেন। সুব্রত সেনশর্মা টফি নিলেন। যমুনা সিংহ একটু হেসে আঙুল দিয়ে নিজের গালের দিকে দেখালেন। শর্মিলা এবং দর্শক উভয়েই বুঝে গেলেন, ওঁর গালে পান ঠাসা। অতএব টফি খাবেন না। এই যে নীরব বোঝাবুঝি, পান-রসে বঞ্চিত কোনও দেশের দর্শক তার নাগাল পাবেন কি? একটা ভাষার সুর কেমন, তার উচ্চারণ কেমন না জানলে সেই ভাষার বাচিক অভিনয়ের মান নির্ধারণ সম্ভব কি? অভিনয়কে দেশজ হয়ে তবেই আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছতে হয়। অভিনেতৃ তাঁর চলায়-ফেরায়, হাত-পা সঞ্চালনায়, বাচনের ভঙ্গিমায়, আবেগের প্রকাশ-বৈশিষ্ট্যে তাঁর দেশ-কাল-সংস্কৃতির অভিজ্ঞানকেই মেলে ধরেন। হাসির কথায় হাসা বা দুঃখের কথায় কাঁদলেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং সেই হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর চরিত্রের ইতিহাস-ভূগোল এবং জীবনবোধকে প্রকাশ করেন। অভিনয়ের ইতিহাস ধরে রাখা মানে তাই অভিনয়ের পরম্পরার পাশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসকেও ধরে রাখা। শরীরের এবং মুখের ভাষাকে ধরে রাখা।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শুধু অভিনয় করেননি, তাঁর লেখাপত্রের মধ্য দিয়ে বঙ্গীয় অভিনয়কলার টীকাকরণের কাজও করে গিয়েছেন বেশ খানিকটা। শুদ্ধ বাংলা শুদ্ধ ভাবে বলার একটা মাপকাঠি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন, যা ইদানীং কালে ক্রমশই দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। বঙ্গীয় অভিনয়ের ইতিহাস প্রণয়ন এবং সংরক্ষণের মাধ্যমেই তার প্রতি উপযুক্ত মর্যাদা প্রদত্ত হতে পারে।