রাজ্য সরকার পরিচালিত স্কুলে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে পাশ-ফেল ফিরছে, ক্লাস ফাইভ আর এইটে। বছরশেষে বেড়া টপকাতে না পারলে পুরনো ক্লাসেই থেকে যেতে হবে। লোকলজ্জা বাদ দিলেও, আর্থিক দিক থেকে পরিবারের পক্ষে এই বিনিয়োগ একেবারেই অলাভজনক, বোঝাসর্বস্ব। এতে সময় যায়, পড়াশোনায় উৎসাহও যায়। একটা সময় আসে, ইস্কুলের বন্ধন ছিন্ন করে পড়ুয়া মিশে যায় স্কুলছুটের দলে। সরকারি ভাষায় ‘ড্রপআউট’ যাকে বলে।
পরীক্ষায় পাশ-ফেলের চাপে স্কুলছুট বাড়ছে, এই পরিসংখ্যান হাতে নিয়ে স্কুলস্তরে পাশ-ফেল তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল কিছু কাল আগে। প্রাথমিক থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ুয়াকে ভাবতে হয়নি পরের ক্লাসে উঠব কী করে। সঙ্গে সঙ্গে এই ভাবনাটাও হারিয়ে গিয়েছিল যে, পড়াশোনাটা কিন্তু শিখতে হবে। সেই জন্যই পড়ুয়ার স্কুলে আসা। ও দিকে, পাশ-ফেলের বদলে চালু হয়েছিল নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা। বছরের শেষে কোনও চূড়ান্ত নম্বরের নিরিখে নয়, তার বাধাহীন পরের ক্লাসে যাওয়ার আগে হাতে থাকবে এমন একটি প্রগতিপত্র, যেখানে লেখা থাকবে পড়ুয়া হিসেবে তার সারা বছরের ‘কাজ’ কেমন হয়েছে। কাজ অর্থাৎ ‘অ্যাক্টিভিটি’। সে বন্ধুদের সঙ্গে কেমন করে দল বেঁধে কোনও বিষয় ভেবেছে, সেটা নিয়ে কিছু কাজ করেছে, অন্যদের দিকে কতটা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, এই সব। পড়ার বাইরে খেলাধুলো, গানবাজনা, নাটক, আবৃত্তি, বিতর্ক, বক্তৃতা নিয়ে তার উৎসাহ কতটা ছিল, এও দেখা হবে। দেখা তো হবে, এ-দিকে অনেক স্কুলেই খেলার মাঠ নেই, নাট্যশালা নেই, কবিতা গান আবৃত্তি শেখানোর কেউ নেই। এই ডামাডোলে, স্বাভাবিক ভাবেই, অঙ্কে, ইংরেজিতে নম্বর কম হলেও যে হেতু পাশ-ফেল নেই, শিক্ষার্থীর খামতির দিকটিতে আর আলো পড়ল না। না শিখে, আর শেখার ব্যাপারে উদাসীন থেকেই পরের পর ক্লাসে তার উত্তরণ ঘটে গেল। কোথাও একটা বার্তা ছড়িয়ে গেল, ছেলে-মেয়ে কিছু শিখছে না অথচ বড় হয়ে উঠছে। গোটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও জড়িয়ে গেল এই গোলমালের সঙ্গে। শুরু হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের অবনমন এবং তার প্রতি সামাজিক অনাস্থার। মানের অবনমন কারণটা সহজ। শেখানোর কোনও দায় তার আর থাকল না।
সাধারণ মানুষের চাহিদা খুব কম। তাঁরা চান সন্তান স্কুলে গিয়ে ইংরেজি আর অঙ্কটা অন্তত শিখুক। তার পর তার সন্তানের গা থেকে ‘অশিক্ষিত’ জোব্বাটা খুলে পড়ুক, আর সে কোথাও একটা সম্মানের কাজে নিজেকে যুক্ত করুক। সন্তানকে মানবিক গুণাবলির আধার করে তোলা খুব বেশি মানুষের সমস্যাও নয়, জীবনের লক্ষ্যও নয়। কাজেই, নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার যে মূল আদর্শ, অর্থাৎ সার্বিক বিকাশ, তাকে সফল করতে গিয়ে, একটি বিদ্যালয় যেন পড়ুয়ার ‘সামাজিক’ চাহিদার থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। আবার অন্য দিকে, এই মূল্যায়নের পরিকাঠামোগত কিছু দিক আছে। একে সফল করে তুলতে হলে শিক্ষা প্রক্রিয়াটিকেও আগে নিরবচ্ছিন্ন ও ধারাবাহিক হতে হবে। সেটা তো সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় বহু বাধাজটে আচ্ছন্ন। সংবৎসর ভোট, বন্যা, অতিগ্রীষ্মের দাপটজনিত বর্ধিত গ্রীষ্মাবকাশ, পার্বণ বিরতির সব ঝড়টাই তো এসে আছড়ে পড়ে বিদ্যালয়ের গায়ে। ছুটি হয়ে যায় স্কুল। ইত্যাকার ‘অতিপ্রয়োজনীয় ও অলঙ্ঘনীয়’ বিষয়ে শিক্ষাপ্রচেষ্টা নিত্য বিচ্ছিন্ন এবং ধারাবাহিকতা-ছুট। অথচ মূল্যায়ন নাকি নিরবচ্ছিন্ন।
এই মূল্যায়ন ব্যবস্থার ধারণাটা ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক কোনও স্তরকেই কি প্রভাবিত করতে পেরেছে? বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছে? পাঠ্যবই নিয়ে অভিভাবকদের যে ধারণা, তাঁরা নিজেরা যে ভাবে পড়েছেন, এখনকার পাঠ্যবই তার চাইতে অনেক আলাদা। প্রধানত কথোপকথন-নির্ভর, ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাভিত্তিক ধাঁচে লেখা এই বইয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি অনেকেই। ‘পাতার পর পাতা পড়বার পরেও বুঝতে পারা যাচ্ছে না, কী প্রশ্ন আসতে পারে এখান থেকে’, এই অভিযোগ উঠেছে। অথচ বইটি লেখাই হয়েছে এই ভাবনা থেকে যে বই নিজে কোনও প্রশ্ন তুলে দেবে না। বিষয়কে এমন ভাবে আলোচনা করবে যেন পড়ুয়ার নিজের ভেতরেই প্রশ্ন আসে। নিঃসন্দেহে এটা খুবই আধুনিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা। কিন্তু, পরিবেশনার দুর্বলতার কারণেই হোক বা অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব বা পড়ুয়াদের অনাগ্রহই হোক, কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।
সুতরাং পাশ-ফেলের প্রত্যাবর্তন। আদর্শতাড়িত উচ্চ গিরিশিখর থেকে কিছুটা নীচে নেমে, কোনও ক্রমে বাঁচার জন্য শ্বাসবায়ু নেওয়ার মতো। অভিভাবক চাইছেন, সন্তান কিছু শিখুক। শিক্ষকরা বলছেন পাশ-ফেল থাকলে তার ভয়ে ছেলে-মেয়েদের মনে শেখার ইচ্ছে জাগুক। বাংলা মাধ্যম স্কুলে এখনও বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে। ক্ষতি হবে জেনেও সেই সব স্কুলও চাইছে পাশ-ফেল ফিরুক। যেখানে কিছু শিখবে কি না তার স্থিরতা নেই, সেখানে অন্তত কিছু না-শেখার ধারণাটা তৈরি হওয়া দরকার। এই হল আমাদের শিক্ষার মান, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে প্রত্যাশা।