পুরাণপুরুষ
সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়
২০০.০০
দে’জ পাবলিশিং
সীমন্তিনী হয়তো সবই দেখেছে। ঘরে টুপি-পরা এক অদ্ভুত জাদুকর, এক হাড়গিলে পাখি, দুটো বামন চেহারার লোক। কিংবা, কিছুই দেখেনি। বামন দুটো বোধ হয় ওর স্মৃতি, বোধশক্তি সবই লোপাট করে দিয়েছে! উত্তর কলকাতার বনেদিপুরুষ রাজারাম রায়ের একমাত্র উত্তরসূরি সীমন্তিনী। দিন কয়েক আগে উইল করে রাজারাম তাকেই সব সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছে।
একটু আগে সীমন্তিনী তার রাতের খাবার সাঙ্গ করেছে। এক বাটি দুধ। আগামী কাল এই শহরে গ্যাসবাতি বসবে। গ্যাসের আলো যে ঠিক কী রকম, রাজারাম জানে না। সে শুধু জানে, “রাবণের দশমুণ্ড কাটিলেন শরে/ পুনর্ব্বার উঠে মুণ্ড বিধাতার বরে।।” বাবার কণ্ঠে শোনা কাশীদাসী মহাভারতের এই দুটো লাইন প্রায়ই রাজারামের কানে বাজে। কেন যে বাজে! শব্দের ছন্দ? পয়ারের চলন? না কি মুণ্ড কাটা ও জোড়া লাগার আশ্চর্য জাদুর অভিঘাত? স্মৃতির কি এক ও একটাই সরলরৈখিক কারণ থাকে? সে কি একই তলে বিরাজ করে? না কি উল্লম্ব, অনুভূমিক নানা তলে ভাঙা কাচের টুকরোর মতো ছড়িয়ে পড়ে?
বামন দুটোর নাম যেমন রাজারামের স্মৃতিতে কোনও ঝঙ্কার তোলেনি। রোজ়েনক্রান্টজ় আর গিল্ডেনস্টার্ন। রাজারাম হিন্দু কলেজের ছাত্র নয়, ইংরেজি জানে না, ফলে নাম দুটো তার কানে ঝঙ্কার তোলে না। কিন্তু একুশ শতকে পাঠকের কানে ওই দুই নাম দুই স্তরে হরেক অনুষঙ্গ বয়ে আনে। শেক্সপিয়রের দোলাচলচিত্ত, সংশয়ী নায়ক হ্যামলেটের দুই বন্ধু। ডেনমার্কের রাজকুমারের পাগলামির কারণ খুঁজতে গিয়ে পাকেচক্রে তারা নিজেরাই খুন হয়।
কাকা ক্লডিয়াস ইংল্যান্ডের রাজাকে লিখেছিলেন, হ্যামলেট যাতে পৃথিবীতে আর না থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। হ্যামলেট সেই চিঠিতে নিজের নাম মুছে রোজ়েনক্রান্টজ়দের নাম বসিয়ে দেয়। বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা? হয়তো। কিন্তু দুই বন্ধু তো রাজার গুপ্তচর হিসাবে কাজ করছিল; হ্যামলেট সত্যিই পাগল কি না, ভূত দেখে কি না, সে সব খুঁজতে গিয়েছিল। বন্ধুরাও আজকাল ক্ষমতার গুপ্তচর!
শেক্সপিয়রের এই নাটককেই তাই তেরছা ভাবে দেখে ষাটের দশকে টম স্টপার্ডের বিখ্যাত নাটক রোজ়েনক্রান্টজ় অ্যান্ড গিল্ডেনস্টার্ন আর ডেড। সেখানে রোজ়েনক্রান্টজ় বাজি ধরে টস করে, টানা ৯২ বার হেড পড়ে। ভুতুড়ে? কিন্তু পারমুটেশন-কম্বিনেশন, সম্ভাব্যতার তত্ত্ব কোনও কিছুতেই জীবনকে বাঁধা যায় না যে!
হ্যামলেটের সেই দুই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বন্ধু এ বার বাংলা উপন্যাসে! তুচ্ছ— কারণ হ্যামলেট, ক্লডিয়াস, ওফেলিয়াদের মৃত্যুই নাটকের ট্র্যাজেডি তৈরি করে, শেষ দৃশ্যে গিল্ডেনস্টার্নরা দু’জনেই মারা গিয়েছে বললে দর্শক নিরুত্তাপই রয়ে যায়। বস্তুত, স্টপার্ডের নাটকে কে রোজ়েনক্রান্টজ় আর কে গিল্ডেনস্টার্ন, তারা নিজেরাই মাঝে মাঝে ভুলে যায়। একই মঞ্চে মহীরুহদের পাশাপাশি তাদের জীবন এতটাই নগণ্য, এতটাই অ্যাবসার্ড!
না, বোধগম্যতার সুবিধার্থে আমি রোজ়েনক্রান্টজ়দের নিয়ে এই সমালোচনায় যতখানি শব্দব্যয় করলাম, পুরাণপুরুষ উপন্যাসে আদৌ সে সব নেই। মিতকথনে বিশ্বাসী লেখক রাজারামকে নিতে আসা দুই মুষ্ক মৃত্যুদূতের নাম রোজ়েনক্রান্টজ় আর গিল্ডেনস্টার্ন বলেই থেমে গিয়েছেন। তার পর পাঠকের যদি কিছু মনে পড়ার হয়, পড়বে। লেখক অত ভাবিত নন। এই মেধাবী মস্তানি হাল আমলের বাংলা উপন্যাসে বহু দিন চোখে পড়েনি।
মস্তানি শুধু শেক্সপিয়র বা স্টপার্ডের চরিত্রদের নাম ধার করায় নয়। উপন্যাসের এক জায়গায় উনিশ শতকের রাজারাম স্বপ্নে দেখে, বহু মানুষ শহরের রাস্তায় হেঁটে চলেছে। কেউ কারও দিকে তাকিয়ে দেখে না। যেন অপরের অস্তিত্ব নিয়ে তারা অবগত নয়। সকলে হাঁটছে, কিন্তু তাদের ডান বা বাঁ হাত কানে রেখে কথা বলতে বলতে হেঁটে চলেছে। বলছে তো বলছেই! ‘সেলফোন’ শব্দটা উনিশ শতকের সময়প্রেক্ষিতে এক বারও ব্যবহার করলেন না লেখক, কিন্তু বুঝতে কিছুই বাকি রইল না। রাজারামের স্বপ্নে কেন সেলফোন আসবে? সময়কে কি ওই ভাবে উনিশ, বিশ, একুশ শতকের গণ্ডিতে মাপা যায়? সময়ের পেটের মধ্যে ঢুকে থাকে আর একটা সময়ের শরীর। রান্নাঘরে লৌহ যুগের সাঁড়াশি দিয়ে গরম কড়াই নামিয়েই তো তুমি ফেসবুক পোস্ট করো, সাইবার-প্রস্তর যুগের একুশ শতক!
এই উপন্যাস কার্নিভালের। কার্নিভাল মানে গোয়া বা পার্ক স্ট্রিটের আলো-ঝলমল খ্রিস্টোৎসব বা গঙ্গার ধারে ঢাউস দুগ্গা ঠাকুরের বিসর্জনী শোভাযাত্রা নয়। ইংরেজি না-জানা রাজারামের হাতে স্যামুয়েল জনসনের ছেঁড়াখোঁড়া একটি অভিধান এসে পড়ে। সেখানেই ‘কার্নিভাল’ শব্দের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। আলোকপ্রাপ্ত শহরের বাইরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন সিধু-কানুর সাঁওতাল বিদ্রোহ, সে সময়েই কাশীপ্রসাদ ঘোষ তাকে ওই শব্দটির অর্থ বুঝিয়ে দেন, আদতে ল্যাটিন ‘কার্নিভালে’ বা ‘মাংস বিদায়’। ইস্টারের আগে ছয় সপ্তাহের উপবাস যে দিন শুরু হবে, তার ঠিক আগে মদ-মাংস-খিস্তিখেউড়ের অমিত উল্লাস। উনিশ শতকের কাশীপ্রসাদ মিখাইল বাখতিন, রাবলে বা উম্বের্তো একোর নাম জানেন না, জানা সম্ভবও নয়। আজ আমরা জানি ক্রীতদাস, চাষাভুষো ও নিম্নবর্গের উৎসব। সে দিন কোনও যাজক বা জমিদারকে নিয়ে খিস্তি, হাসিঠাট্টা করা যেত। ওই একটা দিন ভেঙে তছনছ হয়ে যেত ক্ষমতার থাকবন্দি অস্তিত্ব। মিতকথনে বিশ্বাসী লেখক শুধু সাঁওতাল বিদ্রোহের ইঙ্গিত দিয়ে ছেড়ে দেন। বিদ্রোহ যে কখন কী ভাবে ঘটবে! বাংলা সাহিত্যের পাঠক জানেন, হার্বার্টের মৃত্যুর পর তার মৃত বাবার বিখ্যাত উক্তি: “তুমি কাঁদছো শোভা? এ তো কার্নিভাল।”
এই কার্নিভালে নবারুণ ভট্টাচার্যের স্মৃতির পাশাপাশি রাজর্ষি-র নিঃশব্দ উপস্থিতি। রাজারাম স্বপ্নে দেখেছিল, সেলফোন হাতে চলমান লোকগুলির পায়ে রক্তের ছাপ। সে রাবীন্দ্রিক প্রশ্ন তোলে, “এত রক্ত কেন?” এই যুগে গোবিন্দমাণিক্য-রঘুপতির বিতর্ক আর সম্ভব নয়, ফলে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী মেফিস্টোফেলিস উত্তর দেয়, “এই প্রশ্ন অনর্থক। আগামী দিনে বহু লোক এই প্রশ্ন করবে।”
এই আখ্যানে মেফিস্টো আছে। আছে তার সঙ্গী, কথা-বলা হাড়গিলে পাখি বনবিহারী। নবারুণের দণ্ডবায়সের মতো সে ত্রিকালজ্ঞ নয়, মেফিস্টোকে মাঝে ধমক দেয়, “এতকাল তো নাটকের বিষয় হয়ে এসেছ, নিজেই লেখা শুরু কর এ বার।” শুধু রবীন্দ্রনাথের অনুষঙ্গে থামলেন না লেখক, জার্মান মহাকবি গ্যোটেকে টিপ্পনী দিতেও ছাড়লেন না। কার্নিভালে এ রকমই হয়ে থাকে।
রাজারামের বিত্তসম্পদের একমাত্র উত্তরসূরি সীমন্তিনী আসলে একটি সাদা বিড়াল। রাজারাম যে দিন অবৈধ সম্পর্কের কারণে তার দূর-সম্পর্কের বোন বিনির পেট খালাস করানোর কথা বলে, সে দিনই বিড়ালছানাটি বাড়িতে আসে। মেফিস্টো রাজারামকে কার্নিভাল দেখানোর পর বিড়ালটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সে কি ছিল ছদ্মবেশী বেহিমথ? দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা উপন্যাসে শয়তান ওল্যান্ডের সহচর বেহিমথের কথা লিখেছিলেন মিখাইল বুলগাকভ। সে ভদকা খায়, পিস্তল ছোড়ে, যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও রূপ ধারণ করতে পারে। ক্ষমতাসীন সোভিয়েট লেখকদের সভা ভণ্ডুল করে দেয় সে।
সায়ম বন্দ্যোপাধ্যায়ের এটিই প্রথম উপন্যাস, সাহিত্য অকাদেমির যুব পুরস্কারে সম্মানিত। এতগুলি জাতীয়, আন্তর্জাতিক স্মৃতিসৃজনের মিতভাষ প্রেক্ষিতে ১৩৫ পৃষ্ঠার এই ক্ষীণতনু উপন্যাসের সম্মানিত হওয়ার কথাই ছিল।
পুরস্কার না পেলেও ক্ষতি ছিল না। প্রসঙ্গত, বছর কুড়ি আগেও কলকাতা কর্পোরেশনের প্রতীক ছিল বনবিহারীর মতো হাড়গিলে পাখি। এখন মশাল। বাঙালি জানে, পাণ্ডুলিপিরা পোড়ে না, হাড়গিলেরা মরে না।