লড়াকু: ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে শীতের সকালে শরীর চর্চায় প্রবীণেরা। নিজস্ব চিত্র
শীত পড়লে জবুথবু! সংসারে থাকাটাও আলগা ভাবে। কারণ বোধের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে, বয়স হয়েছে, অবসর নিয়েছেন। তাই সকলে উপেক্ষা করে। প্রবীণদের সম্পর্কে এই ধারণার বদল ঘটাতে বদ্ধপরিকর রঙ্গলাল রায়, ঘনশ্যাম সিংহ, ইলা দত্ত সিংহ, মানিকলাল দত্তরা। শীত বা গ্রীষ্ম, ভোরের আলো ফুটলেই বিছানা ছাড়েন তাঁরা। তখন অনেকের নাতি নাতনি বিছানা আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন। এই প্রবীণদের কেউ ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে, কেউ বাড়ির কাছে মাঠে, কেউ পার্কে নিয়মিত শরীর চর্চা করেন। শরীরচর্চা মানে শুধু হাঁটা বা দৌড়নো নয়। রীতিমতো শটপাট, জ্যাভলিন থ্রো, ডিসকাস থ্রো, হাই জাম্প, লং জাম্প, হিসেব কষে দশ কিলোমিটার দৌড়নো ও পাঁচ কিলোমিটার হাঁটা, হার্ডলস, সবই নিয়মিত অনুশীলন করেন তাঁরা। দিনের পর দিন অরণ্যশহর ঝাড়গ্রামের একদল প্রবীণ এভাবেই নিজেদের ‘ফিট’ রেখে বয়সকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ রাখেন।
তাঁদের বিষম খিদে যে! খিদেটা হল পদকের! রাজ্য, জাতীয়, এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরের বয়স্কদের প্রতিযোগিতায় সোনা, রুপো, ব্রোঞ্জ জিতে তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন ঝাড়গ্রাম জেলা মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাথেলেটিক্সরা।
সংস্থার পথচলা শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকে। ১৯৭৫ সালে প্রশাসনের সহযোগিতায় শুরু হয় বার্ষিক ঝাড়গ্রাম মেলা ও যুব উৎসব। সেই যুব উৎসবে একেবারে যুবকদের মতোই বেশ কয়েকজন প্রবীণ নাম দিয়েছিলেন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। তাঁদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ঝাড়গ্রাম সাবডিভিশনাল ভেটারেন্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন হরেন্দ্রনাথ দাস, অনিমেষ দাশগুপ্ত, দেবদাস মল্লিক, গোবিন্দলাল মৌলিক, স্বপন নামহাতা, অশোক কর, নিশিকান্ত মাইতি, শিবনারায়ণ সিংহের মতো অনেকেই। আশি পেরনো স্বপনবাবু, শিবনারায়ণবাবু, নিশিকান্তবাবু, অশোকবাবুরা এখনও মাঠে আসেন। এখন শিবনারায়ণবাবু বাদে আদি সংগঠনের সদস্যরা আর প্রতিযোগিতায় নামেন না। তবে সংগঠনের কাজ ছাড়েননি। মূল সংগঠক হরেন্দ্রনাথ দাস, অনিমেষ দাশগুপ্ত, দেবদাস মল্লিক, গোবিন্দলাল মৌলিকরা প্রয়াত ।
নয়ের দশকের শেষের দিকে হরেন্দ্রনাথবাবুকে সাহায্য করতে সংগঠনের সহ-দায়িত্বে এলেন অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী মনোজ চক্রবর্তী। হরেনবাবুর মৃত্যুর পরে মনোজবাবু হলেন সংগঠনের সম্পাদক। তাঁর উৎসাহে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ল। ৩৫ থেকে ৯০ বছর বয়সিরা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মহকুমা, জেলা, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে শুরু করলেন। ঝাড়গ্রামের গৃহবধূ ইলা দত্ত সিংহ, দিবাকর মাহাতো, বিনপুরের প্রাক্তন বিধায়ক চুনিবালা হাঁসদা একাধিকবার বয়স্কদের প্রতিযোগিতায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নজির গড়েন। ২০০৭ সালে ইলা ও চুনিবালা ইতালিতে গিয়েছিলেন। গত বছর চুনিবালা ও কল্লোল রায় গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। মনোজবাবুর প্রয়াণের পরে সংগঠনের দায়িত্বে আসেন ঝাড়গ্রামের প্রাক্তন মহকুমা ক্রীড়া আধিকারিক রঙ্গলাল রায়। খেলাধুলোকে ভালবেসে বছর পঁচাত্তরের এই প্রবীণ এখনও অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে যুক্ত। তেমনই সংগঠনকেও এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
বছর দশেক আগে সংগঠনের নাম বদলে গিয়ে হয়েছে ‘ঝাড়গ্রাম সাব ডিভিশনাল মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন’। মহকুমা স্তরের সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্যপ্রাক্তন কাউন্সিলর ঘনশ্যাম সিংহ। রঙ্গলালবাবু আগে ছিলেন মহকুমা সংগঠনের দায়িত্বে। বছর খানেক হল এখন নবগঠিত ঝাড়গ্রাম জেলার ‘ঝাড়গ্রাম ডিস্ট্রিক্ট মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন। তাঁর সাফ কথা, ‘‘আমরা কেউ বুড়োবুড়ি নই। বরং তরুণ প্রজন্মের তুলনায় আমরা বেশি পরিশ্রম করি। নিয়মিত শরীরচর্চা ও অ্যাথলেটিক্সে ডুবে রয়েছি। বয়সটা যে বাড়ছে সেটা ভাবার সময়ই নেই।’’ রঙ্গলালবাবু যুবা বয়সেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কথায়, বয়স্ক মানুষগুলো খেলাধুলো ভালবেসে যেভাবে নিয়মিত শরীর চর্চায় মেতে উঠেছিলেন, এটা আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করেছিল। অবসরের পরে তাঁদের স্বপ্ন সফলের চেষ্টা করছি।
কী স্বপ্ন হরেন্দ্রনাথবাবুরা? বয়স্করা হা-হুতাশ ছেড়ে নতুন করে বাঁচবে। তাঁদের জন্য থাকবে খেলাধুলোর জায়গা। সংগঠনের নিজস্ব ভবন হবে। যদিও সংগঠনের স্থায়ী ঠিকানা এখনও হয়নি। শরীর চর্চা ও খেলাধুলোর জন্য নির্দিষ্ট জায়গাও হয়নি। বয়স্ক-ক্রীড়ার পরিকাঠামো কার্যত কিছুই নেই ঝাড়গ্রামে। ঘনশ্যাম সিংহ জানালেন, ‘‘বয়স হয়ে গেলেই পরিবারে উপেক্ষা, নয়তো নিজেকে বোঝা ভাবা। এটা অনেকে ভবিতব্য ধরে নেন। আমরা এই ধারণা ভাঙার জন্যই শরীরচর্চা করছি। ভাল সাড়া পাচ্ছি।’’ এখন জেলা ও মহকুমা সংগঠনের সদস্য সংখ্যা তিনশোর কাছাকাছি। মহিলা সদস্য রয়েছেন ৭৩ জন। বেশির ভাগ সদস্যই সক্রিয় ভাবে জেলা স্তরের প্রতিযোগিতায় যোগ দেন। নির্বাচিতরা রাজ্য ও জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় যান।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেও বয়স্কদের খেলাধুলোর ইতিহাস উজ্জ্বল। আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে প্রবীণরা ক্রীড়ায় যোগ দিচ্ছেন। ‘মাস্টার অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশন পশ্চিম মেদিনীপুর’ সংস্থাটি কয়েক দশকের পুরনো। এই সংগঠন ভেঙে বছর খানেক আগে নতুন একটি সংগঠন ‘পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলা মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে উঠেছে। এই দু’টি সংগঠনের কর্মকর্তা বাবলু দিগার ও তপন ভকত জানান, প্রবীণদের জন্য মেদিনীপুর শহরে খেলার মাঠের সমস্যা রয়েছে। চারশো মিটার, আটশো মিটার দৌড়নোর কোনও ট্র্যাক নেই। শহরের অরবিন্দ স্টেডিয়ামে তাঁদের অনুশীলন করতে দেওয়া হয় না। বয়স্কদের শরীর চর্চার জন্য জিম প্রয়োজন। সংগঠনের কোনও কার্যালয় ভবন নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার জন্য সরকারি অনুদানও মেলে না। অনেকেরই আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। প্রবীণ ক্রীড়াবিদদের দাবি, প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে যাওয়ার সময় ট্রেনে ও বাসে তাঁদের ছাড় দেওয়া হোক। অসুস্থ ক্রীড়াবিদদের সরকারি খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা হোক। একই দাবি রঙ্গলালবাবুদের।
চলতি বছরের ২২ থেকে ২৩ ডিসেম্বর শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে শুরু হচ্ছে ওয়েস্টবেঙ্গল মাস্টার্স অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ৩৪তম রাজ্য স্তরের বয়স্কদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। যোগ দিয়েছেন রঙ্গলাল, ইলা, রবীন্দ্র দেবনাথ, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী মানিকলাল দত্ত-সহ ২৮ জন প্রবীণ। রঙ্গলাল আশাবাদী, এবারও সোনা, রুপো ছিনিয়ে আনবেন। জয়ের এই খিদেই বাঁচিয়ে রেখেছে ষাট-পঁচাশির যুবক-যুবতীদের।
তথ্য: সৌমেশ্বর মণ্ডল