গৃহস্থালীর নানা কাজে প্লাস্টিকের সামগ্রীরই রমরমা। ছবি: আইস্টক
দূষণ শুধু বাইরের সমস্যা নয়, ঘরের ভিতরেও দূষণের সমস্যা রয়েছে। বাইরের দূষণ আমাদের যেমন ক্ষতি করে, তেমনই ঘরের ভিতরের দূষণ থেকে আমাদের নানারকম শারীরিক ক্ষতি হতে পারে। ফলে বাইরের পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘরের পরিবেশকেও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
ঘরের পরিবেশ দূষিত হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই আমাদের উদাসীনতা ও আলস্য থেকে তৈরি হয়। যেমন, ঘর রং করলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। রঙে নানা ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেগুলি থেকে শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা তৈরি হয়ে পারে আবার যাঁরা এতে ভোগেন তাঁদের সমস্যা আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে। শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জির মতো নানা ধরনের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে রান্নাঘরের আনাচে-কানাচে, কার্পেটের উপরে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ। অনেকে রান্নার জন্য গ্যাসের ব্যবহার না করে কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করেন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। এর থেকেও দূষণের সমস্যা বাড়ে। আসবাবপত্র তৈরির সময়ে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা, রান্না ঘরে পর্যাপ্ত আলো, বাতাস চলাচল করতে না পারা, যত্রতত্র ইঁদুর বা টিকটিকির বিষ্ঠা পড়ে থাকার ফলেও নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বাড়ি সুরক্ষিত রাখতে রাসায়নিক বেশি ব্যবহার করলে এর থেকে গলার সংক্রমণ, চোখের সমস্যা, এমনকি, ক্যানসারের মতো অসুখও হতে পারে।
ঘরোয়া দূষণের অন্যতম উৎস হল প্লাস্টিকের বিভিন্ন দ্রব্যের অবাধ ব্যবহার। আমরা জল রাখার জন্য, খাবার রাখার জন্য— প্লাস্টিকের তৈরি নানা সামগ্রী ব্যবহার করি। কিন্তু প্লাস্টিকে বিসফেনল নামের একটি যৌগ থাকে। এই যৌগ খাদ্যদ্রব্য ও জলের সংস্পর্শে এসে সেগুলিকে দূষিত করে তুলতে পারে। এর ফলে প্রস্টেটের মতো অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে, গর্ভবতী মহিলাদের ভ্রূণেরও ক্ষতি হতে পারে। বোতল, পাইপ-সহ বিভিন্ন ধরনের পাত্রকে মজবুত ও টেঁকসই করতে প্লাস্টিককে পলি কার্বনেটে রূপান্তরিত করতে হয়। এর জন্য বিপিএ যৌগটির ব্যবহার করা হয়। বিপিএ আমাদের শরীরে বিভিন্ন খাদ্যবস্তু ও জলের মাধ্যমে প্রবেশ করে। সাধারণ কোনও প্লাস্টিকের বোতলে গরম জল রাখলে বা প্লাস্টিকের পাত্রে মাইক্রোওয়েভে খাবার তৈরি করলে অথবা পাত্রগুলিকে ডিটারজেন্টে ধুলে বিপিএ মুক্ত হয়। পরে খাবার ও পানীয়ের মধ্যে দিয়ে বিপিএ মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে। বিপিএ-র জন্য ইস্ট্রোজেন মিমিক, স্থূলত্ব, স্নায়বিক অসুখ, থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা নষ্ট হওয়া, স্তন ও প্রস্টেট ক্যানসারের মতো রোগ হতে পারে। সমীক্ষা বলছে, বিপিএ-র ব্যবহারের ফলে হৃদরোগ ও মধুমেহের হারও বাড়ছে। ঘরোয়া বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশে জলজ প্রাণিদের প্রজনন ক্ষমতা ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।
অন্য উপাদানের থেকে দুধ, ফলের রস বা জলের মতো তরল পদার্থের মধ্যে দিয়ে বিপিএ মানবদেহে প্রবেশ করে। গঠনগত ভাবে বিপিএ হরমোনের মতো। হরমোন জননতন্ত্রের বিকাশ, হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, কিডনি ও প্রস্টেটের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ইস্ট্রোজেনের মতো হওয়ায় বিপিএ শরীরের এই স্থানগুলিতে সহজে পৌঁছে যেতে পারে। এবং ইস্ট্রোজেনের কার্যকারিতাকে ব্যাহত করতে পারে। প্লাস্টিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্লাস্টিকের বিকল্প জিনিস যেমন কাচের বোতল, ধাতব খাবারের কৌটো ইত্যাদির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
কঠিন পদার্থের পাশাপাশি, ঘরের বেশ কয়েকটি কঠিন দ্রব্যের থেকেও অসুখ ছড়াতে পারে। ঘরের অগ্নিনিরোধক সামগ্রী তৈরি, শব্দনিরোধক দেওয়াল তৈরি করতে অ্যাসবেস্টস ব্যবহার করা হয়। এর থেকে শ্বাসকষ্ট এবং ক্যানসার হতে পারে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস চলাচল না করলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের জন্ম হতে পারে। মৃত ব্যাকটেরিয়ার দেহ ভেঙে গিয়ে তা থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গত হয়। সেই রাসায়নিকের কারণে অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট ও কাশির মতো অসুখ হতে পারে। ঘরে মশা মারার ধূপ, কয়লা বা কাঠের জ্বালানিতে রান্নার ফলে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস নির্গত হয়। কম পরিমাণে অক্সিজেনে কার্বন জ্বালানিকে দহন করলে সৃষ্টি হওয়া এই গ্যাস রক্তের হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কার্বক্সিহিমোগ্লোবিন গঠন করে। তার জেরে রক্তের অক্সিজেন বহনক্ষমতা কমে যায়। কার্বন মনোক্সাইডের কারণে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, চিন্তাভাবনা গুলিয়ে ফেলার মতো নানা সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত কার্বন মনোক্সাইড ঘরে থাকলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
ঘরে সঞ্চিত ধূলিকণার জেরে নানা ধরনের ডাস্ট মাইটস তৈরি হয়। এগুলি অতি সূক্ষ্ম আণুবীক্ষণিক কীট। এর প্রভাবে হাঁপানি, কাশি, বুকে যন্ত্রণা, চোখ-মুখ জ্বালা করতে পারে। ঘরোয়া দূষণের আর একটি উৎস হল ফর্ম্যালডিহাইড গ্যাস। বিভিন্ন ধরনের বাসন ধোয়ার সাবান, ওষুধ এবং প্রসাধনীসামগ্রীতে এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও সিগারেটের জ্বালানি, ময়লা কাগজ, বিভিন্ন জ্বালানি থেকেও ফর্ম্যালডিহাইড গ্যাস নির্গত হয়। ভোজ্য তেলকে অতিরিক্ত গরম করলেও এটি উৎপন্ন হতে পারে। এই যৌগের কারণে হাঁপানি, হাঁচি, কাশি, বুকে ব্যথার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ঘরোয়া দূষণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে পোষ্যদেরও ভূমিকা রয়েছে। পোষ্যদের গায়ের মৃত কোষ, লোমের অংশ বিশেষ, পাখিদের পালক ইত্যাদি থেকে নানা ধরনের অসুখ হয়। এর থেকে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জির পাশাপাশি ত্বকে সংক্রমণ, র্যাশ, চুলকানির মতো রোগ হতে পারে। এর সঙ্গে সঙ্গে ঘর সাজানোর জন্য যে সব উপাদান আমরা ব্যবহার করি সেগুলি থেকেও নানা অসুখ বিসুখ হতে পারে। তৈলচিত্র, জলের পাইপ ইত্যাদি সামগ্রীতে সীসার মতো উপাদান থাকে। সীসার কারণে খিঁচুনি, অসাড়তা, পেটে যন্ত্রণা, কৌষ্ঠকাঠিন্য-সহ নানা অসুখ হতে পারে। ঘরের ভিতরে ধূমপান করলে তা থেকে নানা বিষাক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয় ও যাঁরা ধূমপান করেন না তাঁদেরও নানা অসুখ হয়। ঘরকে কীটমুক্ত করতে আমরা অনেক সময় মশা মারার স্প্রে-সহ নানা কীটনাশক ব্যবহার করি। এই কীটনাশকগুলিতে ব্যবহৃত রাসানিকও ঘরে নানা সমস্যা তৈরি করে। মাথা ব্যথা, বমি ভাব, গা হাত পা ঝিনঝিন করা-সহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে কীটনাশকে ব্যবহৃত রাসায়নিকের কারণে।
ঘরের দূষণ কমাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে কাচের মতো পরিবেশবান্ধব সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানো। তারই সঙ্গে সঙ্গে ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র, জানলা, দরজা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের অব্যবহৃত দ্রব্য, বেঁচে যাওয়া খাবারের অংশ নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়া প্রয়োজন। ঘরের মেঝেতে কার্পেট ব্যবহার করলে তা নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিবর্তন করা প্রয়োজন। রান্নাঘরে ধোঁয়া বেরনোর জন্য চিমনি বা এক্সজ়স্ট ফ্যানের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। আলো, বাতাস চলাচলের জন্য জানলা, দরজা খোলা রাখাও একান্ত আবশ্যক। এই সব নিয়ম মেনে চললে ঘরোয়া দূষণের হাত থেকে আমরা অনেকটাই মুক্ত হতে পারব।
রিসোর্স-পার্সন পশ্চিমবঙ্গ বায়োডাইভার্সিটি বোর্ড