সন্তান ও ত্রাণ

সমীক্ষা জানাইতেছে, সন্তান হইলে মানুষ আর্থিক অনিরাপত্তা, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে ভুগিতে থাকেন। সত্যই, সদ্যোজাত সন্তানের রোদন ও অন্যান্য লীলা আসিয়া পিতামাতার নিদ্রার বিনাশ সাধন করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৯ ০০:০২
Share:

৫৫,০০০ মানুষকে লইয়া এই সমীক্ষা প্রচলিত মতের বিপক্ষে বিশ্লেষণ উপস্থিত করিল। প্রতীকী চিত্র

জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয় সমীক্ষা করিয়া জানাইল, পিতামাতা সর্বাপেক্ষা সুখী হন, তাঁহাদের সন্তান যখন বড় হইয়া স্বতন্ত্র থাকিতে শুরু করে। ষোলোটি ইউরোপীয় শহর জুড়িয়া ৫৫,০০০ মানুষকে লইয়া এই সমীক্ষা প্রচলিত মতের বিপক্ষে বিশ্লেষণ উপস্থিত করিল। সকলেই জানিত, জীবনের এক আশ্চর্য আনন্দ হইল, সন্তানের মুখ দর্শন, তাহার পর পরম বাৎসল্যে তাহাকে বড় করিয়া তোলা। কিন্তু সমীক্ষা জানাইতেছে, সন্তান হইলে মানুষ আর্থিক অনিরাপত্তা, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে ভুগিতে থাকেন। সত্যই, সদ্যোজাত সন্তানের রোদন ও অন্যান্য লীলা আসিয়া পিতামাতার নিদ্রার বিনাশ সাধন করে। সাংসারিক খরচ অকস্মাৎ এমনই বৃদ্ধি পায়, যে-লোক ভাবিতেছিল প্রত্যহ বিরিয়ানি সাবাড় করিবে, তাহাকে ডালের বড়া দিয়া কাজ চালাইতে হয়। অবসর যাপন বা বিনোদন মাথায় উঠে, বহু দিন পরে মনে পড়ে, কত কাল সিনেমা দেখিতে যাওয়া হয় নাই! সন্তান হাঁচিলে কাশিলে প্রবল উদ্বেগ আসিয়া হানা দেয় তো বটেই, তাহার উপরে সর্ব ক্ষণই মনে হয়, ভাল করিয়া তাকাইয়া দেখা দরকার আদরপুত্তলিটি যথাযথ প্রশ্বাস লইতেছে কি না। প্রকাণ্ড দায়িত্ব আসিয়া স্কন্ধে চাপিয়া সিন্দবাদের দুষ্ট নাবিকের ন্যায় খোঁচা মারিয়া বলে, টাকা জমাও, নহিলে যাহাকে পৃথিবীতে আনিলে তাহার উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হইবে কী রূপে, তাহা ব্যতীত বাস্কেটবল ক্লাসেও তো ভর্তি করিতে হইবে! যে অপরাহ্ণগুলি বাদাম চিবাইতে চিবাইতে পার্কে বসিয়া কাটিত, তাহা সন্তানকে সন্তরণের বা ত্রিকোণমিতির কোচিং-এ লইয়া যাইয়া কাটে। চাকুরি ছাড়িবার প্রশ্নই অার উঠে না, অত্যাচারী বসের মুখের উপর ইস্তফাপত্র ছুড়িয়া ফেলিবার ফ্যান্টাসির অন্ত ঘটে, আবার অফিসে ঘাড় নিচু করিয়া কাজ করিতে করিতে চকিতে অপরাধবোধ চাবুক মারে: সন্তানের সহিত যথেষ্ট সময় কাটানো হইতেছে না।

Advertisement

ইহার বিপক্ষে অবশ্যই আবেগকম্পিত আপত্তি উঠিতে পারে, বিশেষত প্রাচ্য সমােজ। সমীক্ষাটি পাশ্চাত্যের মানুষ লইয়া করা, যাঁহারা জীবনে ব্যক্তিগত পরিসরকে অত্যন্ত মূল্য দিয়া থাকেন ও নিজের সহিত নিজের সময় কাটানোকে আত্যন্তিক উপভোগ করেন। নিজেকে ভালবাসা, নিজের যত্ন নেওয়া, নিজেকে মূল্যবান মনে করিবার দীক্ষা তাঁহাদের রহিয়াছে এবং এইগুলির প্রগাঢ় অনুশীলন তাঁহাদের সমাজজীবনে প্রত্যক্ষ হয়। ফলে, এমনকি সন্তান আসিয়াও যখন তাঁহাদের এই নিরালা অবকাশ হরণ করে, নিজের নিরুদ্বেগ চিন্তাস্রোতের সঙ্গ হইতে বঞ্চিত করে, তখন তাঁহারা হৃত মুহূর্তগুলির জন্য তৃষ্ণার্ত হইয়া থাকেন। প্রাচ্যে এই সকল প্রবণতার বিশেষ বালাই নাই, এইখানে গোষ্ঠীর মূল্য চিরকালই ব্যক্তির তুলনায় অধিক, নিজেকে অভুক্ত রাখিয়া অন্যকে তৃপ্ত করিবার উপদেশ চিরধ্বনিত। শিশু জন্মাইলে যদি বাড়িতে হট্টমেলা বসিয়া যায়, তাহাই যে উচিত, অনেকে মিলিয়া হইচই করিয়া জীবন কাটাইবার মধ্যেই যে আনন্দের একমাত্র সংজ্ঞা নিহিত, তাহা প্রত্যেক সভায় যৌথ পরিবার হারাইবার আক্ষেপ এবং প্রতিটি সিরিয়ালে যৌথ পরিবারের উদ্‌যাপন দেখিলেই অনুভূত হয়। বস্তুত প্রাচ্যে নিজেকে লইয়া সুখী থাকিবার শখকে মনে করা হয় অসামাজিক স্বার্থপর প্রবণতা। শিশুকে আশীর্বাদ হিসাবে না দেখিয়া কিছু পরিমাণেও উপদ্রব হিসাবে দেখা হইতেছে জানিলে, প্রাচ্য-হৃদয় শিহরিয়া উঠে। পাশ্চাত্যেও অবশ্যই শিশুকে প্রাণপণ ভালবাসা হয়, তাহার নির্মল হাস্যে পিতামাতার সত্তা অলীক আলোকে উজ্জ্বল হইয়া উঠে, কিন্তু সন্তান যখন স্বাবলম্বী হইয়া বাড়ি ছাড়িয়া চলিয়া যায়, যখন তাহার ভরণপোষণের ভার আর বহন করিতে হয় না, যখন পুনরায় পা ছড়াইয়া নিজ প্রিয় গ্রন্থটি পড়িবার অবকাশ ঘটে, তখন দ্বিতীয় যৌবনের ন্যায় আনন্দই অনুভূত হয়। দম্পতি তুরস্ক বেড়াইবার পরিকল্পনা করেন, জীবনের উপাদান যে কেবল আত্মত্যাগ নহে, আত্মসেবাও, ইহা প্রতিভাত হয়। প্রাচ্য যখন হাহাকার করিয়া মরিতেছে, সন্তানেরা বিদেশ চলিয়া যাইতেছে ও বুড়াবুড়ি বারান্দায় বসিয়া নিঃসঙ্গতায় পিষ্ট হইয়া তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করিতেছে, অমানুষ এই সমাজ তাহার গুরুজনদের অবহেলা করিয়া অর্থোপার্জনে মত্ত, পাশ্চাত্য তখন হাঁপ ছাড়িয়া বলিতেছে, ফোনে নিয়মিত যোগাযোগও থাকিল, বিশেষ নৈকট্যের ঘর্ষণও হইল না, চমৎকার বন্দোবস্ত। ওয়েস্ট হইল ওয়েস্ট, ইস্ট হইল ইস্ট, ইহাদের ইষ্ট কখনও এক বিন্দুতে মিলিবে না, সমীক্ষা কিঞ্চিৎ কৌতুকপ্রদ ভাবে হয়তো এই সিদ্ধান্তই জাগাইয়া তুলিল!

যৎকিঞ্চিৎ

Advertisement

শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলে, ছোটরা কী শিখবে? রাজনীতিকরা যখন রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন, তখন বাচ্চারা যা শেখে! কোনও নেতা যখন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অনশনে বসে নারকীয় ট্রাফিক জ্যামের জন্ম দেন, তখনই বা নাগরিকরা কী শেখে? শেখে, প্রতিবাদ করতে হলে, ক্ষমতার উদ্ধত নজর জোর করে টেনে আনতে গেলে, কিছু বেনিয়ম করতেই হয়। শিক্ষকদের বেলায়ও ছাত্রেরা শিখবে, তাৎক্ষণিক বিশৃঙ্খলায় দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ আমদানির পদ্ধতি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement