বিদ্রোহ: নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ অবস্থানে বসেছেন কৃষকরা। হিসার, হরিয়ানা, ২৫ নভেম্বর, ২০২০। পিটিআই
লোকসভায় কৃষি বিল পাশ করার পর থেকেই বিবাদ বিতর্ক শুরু হয়েছিল। এখন পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং অন্যান্য বেশ কিছু জায়গায় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বেশ বড়সড় আকার ধারণ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে শাসক দল ঘেঁষা রাজনৈতিক দলগুলোও এই বিলের বিরোধিতা করছে, একজোট হয়ে। বিলটি নিয়ে সরাসরি দু’ভাগ বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবেদকেরা। সব ক্ষেত্রেই যা হয়ে থাকে, এক দল এর ভাল দিকটা নিয়ে বলছে, অন্য দল সমালোচনায় ব্যস্ত। কিন্তু, একটা কথা সত্যি— যদি বিলটিতে এমন কিছুই না থাকত, যাতে হাজার হাজার কৃষক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতেন, তা হলে তাঁরা এতটা আক্রমণাত্মক হতেন না। সমস্যা জটিল না হলে সরকারকে এত বেগ পেতে হত না। কোনও কারণ নেই, শুধু রাজনৈতিক ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষকেরা পথে নেমেছেন— এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তা হলে, সমস্যা কোথায়?
এখন যে ব্যবস্থা চালু আছে, তাতে রাজ্য সরকার কৃষকদের কাছ থেকে শস্য কেনে এবং পয়সা দেয়। তাতে রাজ্য সরকারের কিছু লাভ হয় আর বাজারের পরিকাঠামো সরকারের। কৃষি উৎপন্ন বিপণন কমিটিকে (এপিএমসি) এড়িয়ে বাইরের বাজারে বিক্রি হলে রাজ্য সরকারের রোজগারে টান পড়বে। তাই অনেকে এই বিলকে রাজ্য সরকারকে দুর্বল করার পদ্ধতি বলে সমালোচনা করেছেন। যা-ই হোক, যদি কৃষকদের তাতে উপকার হয়, মন্দ কী?
এ কথায় কেউ কেউ বলতেই পারেন, কিছু সমস্যা আরও গভীরে। ন্যূনতম দামে শস্য কেনাবেচা হয় ওই বিপণন কমিটি আয়োজিত মান্ডিতে। তার বাইরে বিনা ট্যাক্সে বেসরকারি কেনাবেচা শুরু হলে মান্ডিগুলো অকেজো হয়ে পড়বে। তখন ন্যূনতম দামও হয়তো আর পাওয়া যাবে না। এই ভয় সবচেয়ে বেশি পঞ্জাব আর হরিয়ানাতে। সেখানে শস্যের সিংহভাগ ওই বাজারে ন্যূনতম দামে বিক্রি হয়। রাজ্য সরকারের তৈরি মান্ডির পরিকাঠামোজনিত সমস্যা— ন্যূনতম দাম ধীরে ধীরে উঠে যেতে পারে, সেই ভীতি উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়।
এ দেশে অনেক কৃষকই তো ন্যূনতম দাম পান না। বেসরকারি কেনা-বেচা দিয়ে বাজার সম্প্রসারিত হলে তাঁদের ক্ষতি কেন হবে? এখানে মনে রাখা ভাল, এ দেশে নতুন বাজার মানেই কিন্তু দুর্বল জোগানদারকে সঠিক দাম দেওয়া নয়। বেসরকারি ব্যবসা মানেই মুক্ত প্রতিযোগিতা নয়। অর্থনীতি বলে, বাজার যত বড় হবে, তত চাষি তাঁর পণ্যের বেশি দাম পাবেন। কিন্তু কৃষির বাজার কয়েক জন বড় ব্যবসায়ী কুক্ষিগত করবেন, এই ভয়টাও যথার্থ। বিশেষ করে, যখন সরকারি কোম্পানি বিক্রি করে টাকা জোগাড়ের জন্য কিছু বিশিষ্ট বড় ব্যবসায়ীকে চিহ্নিত করা হচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করছেন।
হয়তো অনেক চাষি ন্যূনতম দামে বিক্রি না করে মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়েদের কাছে ন্যূনতম দামের চেয়ে কমে বিক্রি করেন। কিন্তু হতদরিদ্র চাষি এখন অনেক কম, তাই ফড়েরা নীলকর সাহেবের মতো ভয়ানক নয়। তাদেরও করে খেতে হয়। তা ছাড়া, ন্যূনতম দাম ও ফড়েদের কাছে বিক্রির দামের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ১০০০ টাকার ন্যূনতম দামের জায়গায় ফড়েরা ৭০০ টাকা দিলে কোনও গ্যারান্টি নেই ভবিষ্যতে বেসরকারি কোম্পানি ৬০০ টাকার বেশি দেবে।
এ কথাও অর্থনীতির অঙ্ক আমাদের শিখিয়েছে যে, প্রথম প্রথম কোনও নতুন বড় মাপের ব্যবসায়ী হয়তো খানিকটা বেশি দাম দেবেন, তাতে প্রতিযোগী সরকারি ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়লে, তখন তাঁরা কম দামে জিনিস কিনবেন। যখন চাষিদের আর ফিরে যাওয়ার রাস্তা থাকবে না। যে সব জায়গায় ন্যূনতম দাম সাধারণ ভাবে কৃষকেরা পেয়ে থাকেন, সেখানে ভয়টা সবচেয়ে বেশি। কোভিড সমস্যা বা দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহের নামে সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগের পিছনে যত যুক্তিই থাক না কেন, এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, সারা বিশ্বে ক্ষমতার অলিন্দে বড় ব্যবসা আর রাজনীতির করমর্দন, এ দেশে কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর জনমানসে গড়ে ওঠা প্রতিকৃতি, আমাদের সন্দেহগ্রস্ত করে তোলে।
মুক্ত বাজার মোটেই ঘৃণ্য ব্যবস্থা নয়। যাঁরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিয়ে, কৃষকদের কম দাম দিতে চান— আমি তাঁদের দলে নই। সঠিক ভাবে মুক্ত বাজারের ব্যাপ্তি সেই বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সুবিধে দেবে, এটাই অর্থনীতি বলে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রিত বা কুক্ষিগত হবে না, এ নিশ্চয়তা এ দেশে কেউ কোনও দিন দিতে পারেননি। যেখানে বড় বেসরকারি ব্যবসা ঢুকেছে, সেখানেই বাজার কুক্ষিগত হয়েছে। কৃষিতেও কি তা-ই হবে?
মনে হতে পারে পঞ্জাব, হরিয়ানায় বড়লোক চাষিদেরই শুধু সমস্যা পোহাতে হবে। এ কথা সত্যি নয়— সত্যি হলে এত সমর্থন তাঁরা পেতেন না। ন্যূনতম দামের প্রতিশ্রুতি খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কনট্র্যাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিবদ্ধ চাষের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো অন্য রকম। যদিও একেবারে কোনও চুক্তিবদ্ধ চাষ না হওয়া বা শুধুই চুক্তিবদ্ধ চাষ হওয়া— দুটোই অর্থনীতির উপদেশকে উপেক্ষা করে। সবাই চুক্তিবদ্ধ হয়ে প্রচুর পয়সার জন্য আফিমের চাষ করলে, দেশটাকে খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে না। কথাটা নিশ্চয়ই হাস্যকর, কিন্তু লাভ-ক্ষতির বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার দায় বাজারের নেই।
কতকগুলো কথা মনে রাখলে কৃষক বিদ্রোহকে সঠিক ভাবে যাচাই করতে পারব আমরা। প্রথমত, শস্য কেনার বাজার বড় হলে সব সময় সঠিক দাম পাওয়া যায় না। তার জন্য শস্যের বাজারে বড় ব্যবসাকে শ্যেনচক্ষু দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। দ্বিতীয়ত, ন্যূনতম দামের মধ্যে একটা বড় অংশ কৃষিপণ্যের বিমার কাজ করে। যে দেশে এখনও আমরা খরা ও বন্যার ভয়ে কুঁকড়ে থাকি, সেখানে প্রতি দিন দু’বেলা ১৩০ কোটি লোককে খাওয়াতে গেলে ন্যূনতম দামই চাষিদের ভরসা। সরকার কি মুক্ত বাজারে ন্যূনতম দাম বেঁধে দেবে এবং সে দাম না পেলে সরকার ন্যূনতম দাম দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে? কারণ, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হলে সরকার বড় বেসরকারি ব্যবসাকে চাপ দিতে পারবে না। দাম নিয়ে দর কষাকষিতে কৃষকের কাছে সব সময় সরকারি ন্যূনতম দামে বিক্রির সুযোগ থাকবে।
সরকার আর একটি সংশোধনী বিল এনে বলতে পারে: যেখানে যে বাজারই থাকুক না কেন, ন্যূনতম দাম সরকার বেঁধে দেবে এবং কোনও কারণে বেসরকারি সংস্থা সেটা না দিতে পারলে, সরকার সেই দামে শস্য কিনে নেবে; আর সেই ন্যূনতম দামে কৃষক চাইলে বেসরকারি কোম্পানিদের না দিয়ে সরকারকেই বিক্রি করতে পারবেন। আর, সারা দেশে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া বলবৎ করবে, যেমন করছে এখন। বেসরকারি ব্যবসায় কর বসিয়ে রাজ্য সরকার চালু মান্ডিগুলোকে সচল রাখবে।
রাজ্য সরকারের ক্ষমতা ও আয় খর্ব করা আর কৃষদের ন্যূনতম দামের গ্যারান্টি না দেওয়া, এই দুটোই বড় সমস্যা। নতুন বিলের ফলে যে বাজার বসবে, সেখানে কৃষকেরা সুরক্ষিত কি না, সেই প্রশ্নই আজ সরকারকে সমস্যায় ফেলছে। বেসরকারি ভাবে বাজারকে প্রসারিত করেও ওই সমস্যাগুলোর খানিকটা সমাধান করা যায়। ন্যূনতম দামকে সংবিধানসম্মত প্রতিষ্ঠা দেওয়া। এখনও ন্যূনতম দাম নিয়ে সরকার কিছুই বলেনি, কিন্তু সরকারের সঙ্গে বেসরকারি আঁতাঁতকে মানুষ এ দেশে কোনও দিনই ভাল চোখে দেখেননি।