পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
জগৎ জুড়ে রবিশঙ্কর জন্মশতবর্ষ উৎসব পণ্ড হল করোনাভাইরাসে। তবে মাটিতে গড়ানো দুধের জন্য কেঁদে লাভ নেই। যে মানুষটার জন্য গোটা জীবনটাই একটা উৎসবের মতো, সেই উৎসবের স্মৃতিতে ফিরলে এ বছরটায় যা হল না তার আক্ষেপ যাবে। ১৯৯৫-এ দিল্লিতে এক মহোৎসব হল ওঁর ৭৫তম জন্মদিবস পালনে। সেই বিশাল কর্মকাণ্ডে প্রায় দিশেহারা ভদ্রলোক (তার কিছু দিন আগে হার্ট সার্জারি থেকে সেরেছেন) জন্মদিনের সকালে আমাকে দূরদর্শনের জন্য নেওয়া সাক্ষাৎকারে কী বলছেন? না, কাশীতে প্লেগের মড়কে ওঁর প্রিয় ছোড়দা’র চলে যাওয়া মাত্র আঠারো বছর বয়সে!
কথা হচ্ছে পঁচাত্তরতম জন্মদিনে, আর শিল্পী ক্রমান্বয়ে ফিরে যাচ্ছেন কাশীর সেই দুঃখকষ্টের দিনগুলোয়। ১৯৭৭-এর নভেম্বরে ওঁর ‘রাগ-অনুরাগ’ বইয়ের কাজে এক বার কাশী গিয়ে দেখলাম তখনও ওঁর হৃদয় জুড়ে বাঙালিটোলা আর গঙ্গার ঘাট। বাঙালিটোলায় ওঁদের সেই টালমাটাল অবস্থার বাড়িটা এক বার দেখাতে নিয়ে গেলেন। আঙুল তুলে দেখালেন সেই ঘরটা যেখানে জন্মেছেন। আর কী সুন্দর করে বললেন, ‘‘ইট অল স্টার্টেড হিয়র!’’ এখানেই শুরু।
দিল্লির সেই জন্মোৎসবের আরও দুটো প্রসঙ্গে যাব। দুপুরের খাওয়ার পর গল্প হচ্ছিল। আমি ওঁকে মনে করালাম ১৯৭০-এর ওঁর পঞ্চাশতম জন্মদিন পালন রবীন্দ্র সদনে। ওঁর বাজনা ছিল সুরেশ সঙ্গীত সংসদের অনুষ্ঠানে। সংসদের তরফে ধুতি, চাদর, মালা, মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হল ওঁকে বাজনার আগে। যদ্দুর মনে পড়ে উনি বাজনা শেষ করেছিলেন পঞ্চম-সে-গারা দিয়ে।
আরও পড়ুন: শরৎবাবুর কোয়রান্টিন, বঙ্কিমের মড়ক, বাংলা সাহিত্যে মহামারি
রবিশঙ্কর একই সঙ্গে অবাক ও খুশি হয়ে বললেন, ‘‘তোমার মনে আছে সেটা!’’ তার পর একটু চুপ থেকে বললেন, ‘‘এই সব ছোটখাটো ব্যাপারগুলোই খুব বড় হয়ে উঠছে আজ।’’ বললাম, ‘‘আপনিও তো কিছুই ভোলেন না দেখি।’’ রবুদা এ বার রীতিমতো দার্শনিক হয়ে গেলেন, ‘‘গানবাজনা তো মনে রাখারই আর্ট। বাবার বকাঝকা, শেখানোর সবই তো ছবির মতো দেখি আজও। ছেলেবেলার কাশীর দিনগুলোয় দুঃখকষ্ট ছিল, আবার কত আনন্দও। তোমায় বলেছি সে সব। ওই যে তোমাদের ইংলিশ পোয়েট শেলি বলেছেন না... বলো না... ’’
আমায় যোগ করতেই হল, ‘‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.’’
রবুদা ধরে নিলেন, ‘‘মিউজিক এটাই করে, কাঁদিয়ে আনন্দ দেয়।’’
তখনও ভাবতে পারিনি সন্ধেবেলায় জন্মদিনের অনুষ্ঠানের গোড়ায় কী বলতে চলেছেন রবিশঙ্কর। বিশাল অডিটোরিয়াম থিক থিক করছে শ্রোতায়। রবিশঙ্কর কন্যা অনুষ্কাকে পাশে নিয়ে বসলেন। শুরুর আগে বললেন, ‘‘আপনারা হয়তো জানেন কিছু দিন আগে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তখন একটা গল্পই বার বার মনে এসেছে। উস্তাদ বিলায়েত খাঁ’র ঠাকুর্দা মহান এমদাদ খাঁ’র জীবনের ঘটনা। উস্তাদ জীবনেও কোনও দিন রেওয়াজ বন্ধ রাখেননি। তো যে দিন ওঁর প্রিয় কন্যা অকালে মারা যাচ্ছে, সবাই এসে ডাকাডাকি করলেও উনি চোখ বন্ধ করে বাজাতে বাজাতে কেবলই হাতের ইশারায় বোঝাচ্ছেন— সবুর করো, শেষ করেই আসছি।’’
‘‘এক সময় মেয়ের দেহ নিয়ে লোকদের বেরিয়ে যেতেই হল কবরের দিকে। রেওয়াজ শেষ করে তা শুনে উস্তাদের সে কী কান্না! রেওয়াজ সারতে গিয়ে মেয়ের মুখটা শেষ বারের মতো দেখতে পেলাম না!’’
‘‘তা আমারও সেই দশা হাসপাতালের বেডে। কেবল ঈশ্বরকে বলছি, ‘প্রভু, আমায় আর কিছু দিন দিন। আমার মেয়েটা ছোট, ওকে আর একটু বড় করে যাই। এমনিতে যেটুকু-যা দিয়েছেন তাতেই তো ভরে আছি।’ ’’ বলেই ধরে নিলেন রাগের আলাপ।
***
রবিশঙ্করের শততম জন্মদিনের লগ্নে দাঁড়িয়ে নতুন করে অনুভব করছি কী আনন্দময় এক পুরুষের সঙ্গ পেয়েছি বছরের পর বছর ধরে। বলতে গেলে ওঁর জীবনের সেরা সময়গুলোয়। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে আটের দশকের মাঝামাঝি অবধি উনি যা ছুঁচ্ছেন, সোনা হচ্ছে। এর আগে আর একটা পর্ব গিয়েছে পাঁচের দশকে, যখন সত্যজিৎ রায়ের ছবির সুর করেছেন, বিলায়েত খাঁ’র সঙ্গে সেতারের প্রবল রাইভ্যালরিতে জড়িয়েছেন, আর আলি আকবর খাঁ’র সঙ্গে গড়ে তুলেছেন ওঁর বিশ্ববন্দিত যুগলবন্দি। তবে ছয়ের দশকের মাঝখানে বিটল জর্জ হ্যারিসন ওঁর শিষ্য হওয়ায় নতুন যে এক খ্যাতি ভর করল সেটা প্রায় রূপকথা। ছয়ের দশকের শেষ থেকে যখন ওঁকে চিনছি তখন উনি বলতে গেলে দ্বিতীয় উদয়শঙ্কর। অর্থাৎ স্বর্গের শিব মর্ত্যে। উদয়শঙ্করকে দেখে যেমন এক মেমসাহেব পরম বিস্ময়ে বলেছিলেন, ‘‘Oh, he talks!’’ উনি কথা বলেন!
হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার বড়কর্তা তখন অভীক সরকার। উনি বার কতক আমায় পাঠিয়েছিলেন রবিশঙ্করের সাক্ষাৎকার নিতে। এ রকমই এক বার শিল্পী বললেন, ‘‘এ রকম কাজ তো অনেকই হল। এর পর বড় করে ভাব।’’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘তার মানে বই!’’ উনি হেসে বলেছিলেন, ‘‘ন্যাচারালি। আরও ভাল হয় যদি হয় বাংলায়।’’
আজ বলতে দ্বিধা নেই যে এই আনন্দময় পুরুষটির এক মস্ত বড় আনন্দের প্রস্রবণ হয়েছিল ‘রাগ-অনুরাগ’ বইটি। এক দিন আমায় যেমন বলেছিলেন, ‘‘জানো খোকা, মাঝে মাঝে ওল্টাই আর ভাবি কত কী যে দিয়ে ফেলেছি এই এক বইয়ে। তুমি পড়ো?’’ বলেছিলাম, ‘‘যখন খুশি। ইট্স মাই বাইবেল।’’
‘রাগ-অনুরাগ’-এর কথা টেপ করার প্রথম দু’দিন নোটবইয়ে লেখা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হতাম। তৃতীয় দিন (সেটা দিল্লিতে) উনি বললেন, ‘‘এর পর থেকে কোনও কাগজ এনো না সঙ্গে। ভাবনাচিন্তা, প্রশ্ন-ট্রশ্ন সব বাড়িতে করবে। আমার সামনে এলে যা মনে আসবে জিজ্ঞেস করবে। আর আমি বলে যাব। দেখবে বই ঠিক হয়ে যাবে।’’
এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয় লন্ডনের সেই দিনগুলোর কথা। সারা দিন ওঁর কথা রেকর্ড করে মাঝরাত্তির অবধি আমার আস্তানায় সেই সব বাজিয়ে বাজিয়ে লেখার অনুভূতির তুলনা, আমার মনে হয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইনের লেকচারের নোটস নেওয়ার অনুভূতি সেই সময়ের ছাত্রছাত্রীদের। যে ভাবে দার্শনিকের ‘ব্লু অ্যান্ড ব্রাউন বুকস’ তৈরি হয়েছিল। রাত্রে লেখার সময় রবুদার কথা যেন গানের মতো বাজছে কানের ওপর। একই সঙ্গে বিনোদিত ও শিক্ষিত হচ্ছি। এক অদ্ভুত কথাসরিৎসাগর।
আরও পড়ুন: পুরুষরা ঠিক যে নারীকে চায়
১৯৭৭-এ রবুদা’র বিটলস সংশ্রবের সেই দুরন্ত রকস্টার ইমেজ অনেকটাই প্রশমিত, কারণ তত দিনে ইহুদি মেনুহিনের সঙ্গে ওঁর সেতার-বেহালা ডুয়েট, অন্দ্রে প্রেভিনের কন্ডাক্টিনে সিতার কনচের্তো রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছে, কলার দেওয়া পাঞ্জাবি আর ট্রাউজার্সের সেই গুরু ইমেজের জায়গা নিয়ে ওঁর পণ্ডিতমূর্তি, স্কলার ইমেজ। লন্ডনের রাস্তায় উনি তখনও গুরু পাঞ্জাবি আর ট্রাউজার্স পরে চলেন, হঠাৎ-হঠাৎ কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে ওঁকে দেখতে থাকে, রবুদা সামান্য হেসে দিব্যি চলতে থাকেন। পাশে হাঁটতে থাকা আমাকে গলা নামিয়ে বলেন, ‘‘এটাই ভাল, জানো তো। অন্তত হাঁটতে চলতে পারছি, ফ্যানদের পাগলামি যে কোথায় চড়তে পারে তা-ও তো দেখা।’’
রবিশঙ্কর ও সেতার তত দিনে প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে। শুধু সেতার কেন, ভারতীয় সঙ্গীতই তত দিনে পাশ্চাত্যে এক ডাকে চলছে— রাভিশঙ্কর!
দু’একটা অ্যানেকডোট বোঝাই তা হলে। ১৯৮০-র শীতে আমার স্ত্রী ইন্দ্রাণীকে নিয়ে আথেন্সে আছি। ওখানকার নামকরা সলিসিটার, তাঁর স্ত্রী আমাদের নিয়ে গেলেন শহরের সেরা নাইট ক্লাবে। যেখানে সে দিন গান আছে তখনকার গ্রিসের সেরা পপ সিঙ্গার পারিয়স-এর। নামেই পপ, কিন্তু পারিয়স যা গাইলেন তা সেরা কলাবন্তদের গলা দিয়েই বেরবে। আর সেই পারিয়সের সঙ্গে শো-এর পর দেখা করতে যেতে কী বললেন? ‘‘ইউ আর ইন্ডিয়ান? রাভিশঙ্কর?’’ আমরা মাথা নাড়তে ফের সেই নড়বড়ে, সুমধুর ইংরেজিতে ‘‘আই অ্যাম ডেড ফর রাভিশঙ্কর!’’
আথেন্সে অবশ্য এটা দ্বিতীয় ধাক্কা ছিল। প্রথম ধাক্কাটা তার দু’দিন আগে গ্রিসের সর্বকালের এক সেরা কম্পোজার মিকিস থিওডোরাকিসের বাড়িতে। থিওডোরাকিস গ্রিসের বুজুকি মিউজিককে বিশ্ববিখ্যাত করেছেন ‘জোর্বা দ্য গ্রিক’ ছবির সঙ্গীত রচনা করে। উনি ফরাসিতে ওঁর আত্মজীবনী ‘মা ভি এ মা মুজিক’ (ইংরেজিতে ‘মাই লাইফ অ্যান্ড মাই মিউজিক’) আমায় উপহার দিতে আমি বলেছিলাম, ‘‘ঠিক এই নামেই একটা আত্মজীবনী আছে রবিশঙ্করের।’’ শুনেই চমকে উঠলেন থিওডোরাকিস, ‘‘তাই নাকি! আমি তো ওঁর সেতার রেকর্ডে, টিভিতে শুনি। অসাধারণ!’’ তার পর যেটা বললেন তা তো সোনার জলে লিখে রাখার মতো। পরে এক দিন রবুদা’কে এ কথা বলাতে রবিশঙ্কর-যে-রবিশঙ্কর সেই তিনিও শিহরিত হয়েছিলেন। গ্রিক মায়েস্ত্রোর কথাটা ছিল: ‘‘ওঁর ‘পথের পাঁচালী’-র সুর দিয়ে আমি ভারতকে চিনি। আমার ‘জোর্বা দ্য গ্রিক’-এর সুর দিয়ে যেমন মানুষ গ্রিসকে চেনে।’’
১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পর নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়্যার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে করা ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে বেশ গর্ব ছিল রবুদা’র। কী ভাবে বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো স্টারকে এককাট্টা করা গেল, রাখা গেল আলি আকবর খাঁ, আল্লা রাখা এবং কমলা চক্রবর্তীকে, সে কথা আমাকে শোনাতেন। প্রয়োজনে টুকটাক সংযোজন করতেন দক্ষিণী কমলা। যেমন একটা টুকরো...
কনসার্টের তোড়জোড় চলছে যখন, তখন এক দিন রবুদা’র লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়িতে ফোন বেজেছে। ফোন তুলেছেন কমলা, ওপার থেকে এক অপূর্ব পুরুষালি ও রোমান্টিক কণ্ঠে প্রশ্ন: ‘‘ইজ রাভি দেয়ার?’’
কমলাদি বলছেন, ‘‘গলা শুনেই তো আমি পড়ে যাই। তবু জিজ্ঞেস করতে হল, হুজ স্পিকিং?’’
উত্তর এল, ‘‘ইট্স মার্লন।’’
কমলাদি বলছেন, ‘‘আমি আর কথা না বাড়িয়ে রবুকে ডাকতে গেলাম। ও তখন চান করছে। বললাম, সাম মার্লন কলিং ইউ। কী বলব?’’
রবু তোয়ালে জড়ানো অবস্থায় দৌড়ে বেরিয়ে এল, ‘‘ধরতে বল, ধরতে বল। ইটস মার্লন ব্র্যান্ডো।’’
যা শুনে কমলাদি’র সত্যি সত্যি পড়ে যাওয়ার দাখিল!
ব্যাপার কী? না ব্র্যান্ডো জানাচ্ছেন, ‘‘রাভি, আমি মুগ্ধ তোমার আর জর্জের এই প্রয়াসে। হৃদয় থেকে সমর্থন করছি। তোমার এই ধরনের কাজে আমার কিছু করণীয় থাকলে জানিও। ফর ইউ আই’ম জাস্ট আ ফোন কল অ্যাওয়ে।’’
কষ্ট হলেও কান্নার কারণ নেই। রবিশঙ্করের কীর্তি ও গাথা কয়েক শতাব্দী ধরে প্রসার পাবে। আর উৎসব? বছর চল্লিশ আগে ‘জলসাঘর’ গোষ্ঠী ওঁর সম্মানে যে ‘বাবু সন্ধ্যা’-র আয়োজন করেছিল চোরবাগানের মার্বেল প্যালেসে এমনটি আর জন্মেও হবে না কলকাতার বুকে। কারণ সেই রবিবাবুটিও নেই, আর এমন অপরূপ বাঙালি বাবু-বিবিও কোথায় মঞ্চ ভরানোর জন্য?
২০২০-র ৭ এপ্রিলে আফশোস দু’টি। এক, লন্ডনের ব্ল্যাক ক্যাবে যেতে যেতে এক দিন রবুদা’ বলেছিলেন ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ অবধি লেখা ওঁর বাংলা ডায়েরির কথা। যা পরে উনি আর লেখেননি। তাতে প্যারিসের জীবন, মাইহারের আশ্রয়ের জীবন, প্রেম, পরিণতি, বিচ্ছেদ অনেক কিছুই ছিল। বলেছিলেন, ‘‘সুন্দর করে এডিট করে, নোটস লিখে ভূমিকা করে বার কর। তবে আমার মৃত্যুর পর। তোমায় দিয়ে যাব সে-ডায়েরি।’’
সেই ডায়েরি ওঁর আর দিয়ে যাওয়া হয়নি। হয়তো ওঁর পরিবারের মধ্যে রয়েছে। এই ডায়েরির ঐতিহাসিক মূল্য যদি তাঁরা না বোঝেন তা হলে ইংরেজিতে ওঁর নতুন, নতুন বায়োগ্রাফি লিখিয়ে কোনও কাজে দেবে না। রবিশঙ্করের জীবনের সেই অপূর্ব দিনগুলোর ছবি অন্ধকারেই থেকে যাবে।
দ্বিতীয় আফশোস এই কারণে... রবুদা’র মন করেছিল দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর দর্শন নেবেন। ওঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সঙ্গে ইন্দ্রাণী (তখনও স্ত্রী হয়নি) আর ওঁর দুই সচিব রবীন পাল, আনন্দ দুবে ও আনন্দবাজারের আলোকচিত্রী অলোক মিত্র। পুজো দেওয়ার পর উনি ঠাকুর রামকৃষ্ণের ঘরে গিয়ে বসলেন। আমায় বললেন, যে-বারান্দায় নিয়ে ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন সেটা দেখাতে। তার পর ঠাকুরের ঘরে সামনের সিঁড়িতে অনেক ক্ষণ কপালে হাত জড়ো করে বসলেন।
এক সময় উঠে বললেন, ‘‘চল, একটু গঙ্গা দেখি।’’
সে দিকে যেতে একটু মজার ছলেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘‘কী চাইলেন মা’র কাছে?’’
একটু হাসলেন, তার পর বেশ সিরিয়াস টোনে বললেন, ‘‘তুমি তো আমার তৈরি ঈশ্বরী গোত্রের রাগিণীগুলো শুনেছ। পরমেশ্বরী, গোপেশ্বরী, গঙ্গেশ্বরী, কামেশ্বরী। একটু মাথায় খেলাচ্ছিলাম যদি এর পর রচনা করতে পারি দক্ষিণেশ্বরী। আর তাতে একটু রামপ্রসাদীর ছোঁওয়াও রাখব।’’
জানি না সেই রাগিণী শেষ অবধি রচনা হয়েছিল কি না। আমি মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতাম। তার পর এক সময় তা-ও চুকে গেল।