রামকিঙ্কর বেইজ। ফাইল ছবি
শিল্পী রামকিঙ্করের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নাম। তিনি রাধারানি দেবী। তাঁর জন্ম বর্ধমানের আউশগ্রামের গুসকরার কাছে কোনও এক গ্রামে। ছোটবেলায় অজয়ের বন্যায় সব ধুয়ে মুছে গেলে বাবার সঙ্গে গোটা পরিবারটি উঠে এসে বসবাস করতে শুরু করে ভেদিয়ার রেলপাড়ে। সেখান থেকেই বাবার পছন্দের বোলপুরের এক মুদি দোকানের মালিক, বছর তিরিশের চণ্ডী গড়াইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রাধারানিদেবীর। তখন তিনি ন’বছরের বালিকা। ভেদিয়ার গ্রাম থেকে বোলপুরে গিয়ে জীবন কাটছিল। কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। বিয়ের কয়েক মাস পরেই সাংসারিক অশান্তি শুরু হয়। দিনে দিনে তা চরমে ওঠে। এ অশান্তির মাঝে বাবার কাছে ফিরে যাবেন এমন অবস্থা ছিল না রাধারানিদেবীর। কারণ, সে পরিবারেও অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী।
সমস্যার মেটাতে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে বোলপুরে কাজের খোঁজে এলেন রাধারানি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা মীরাদেবীর বাড়িতে মাসমাইনে ও থাকা-খাওয়ার শর্তে কাজে বহাল হলেন। সেখানেই রাধারানিদেবী রবি ঠাকুরকে দেখেন। এখানেই প্রতিমাদেবীর সঙ্গে আলাপ হয় রাধারানিদেবীর। রাধারানিদেবীকে খুব ভালবাসতেন প্রতিমাদেবী। এক বার রাধারানিদেবীকে তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়ে ছিলেন, মীরাদেবী রাজি হননি।
মীরাদেবীর বাড়িতেই অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ হয় রাধারানিদেবীর। সেখানেই প্রথম দেখা, ধুতির ওপর ফতুয়া পরা অগোছালো চেহারার মানুষটিকে। কালো, ঝাঁকড়া চুল উজ্জ্বল চোখের মানুষটি। তিনি রামকিঙ্কর বেইজ। তত দিনে রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন। মীরাদেবীর কাছে এসে রাধারানিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন রামকিঙ্কর। এক বার নয়, বার বার। কারণ, বাড়িতে রান্না, দেখাশোনার লোক নেই। অবশেষে রাজি হন মীরাদেবী।
রামকিঙ্কর ও রাধারানিদেবী। —ফাইল ছবি।
তবে সংসার সামলানোর পাশাপাশি, তাঁর শিল্পকর্মের সঙ্গেও জড়িয়ে গেলেন রাধারানিদেবী। রাধারানিদেবীকে নিয়ে নানা শৈল্পিক কাজ করেছেন রামকিঙ্কর। তাঁকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ছবি এঁকেছেন, ভাস্কর্যের কাজও করেছেন। সেই সময়ে দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে শান্তিনিকেতনে ঢি ঢি পড়েছিল। আপত্তিও উঠেছিল। এই খবর পৌঁছে গিয়েছিল রাধারানিদেবীর বাপেরবাড়ি পর্যন্ত। তার পর থেকে রাধারানিদেবীর বাবা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর কর্মকর্তারাও আপত্তি জানালেন! কিন্তু রামকিঙ্কর অনড়। দেশিকোত্তম পেয়েছেন রামকিঙ্কর। ছাত্ররা গিয়ে জানালেন, তাঁকে সংবর্ধনা দেবেন। উপাচার্যও থাকবেন সেই অনুষ্ঠানে। রামকিঙ্কর জানালেন, মঞ্চে উপাচার্য এবং তাঁর পাশে সম-মর্যাদায় রাধারানিকে আসন দিলে তবেই তিনি যাবেন। পরে সারা জীবনের সম্বলের কিছু দিয়ে ভুবনডাঙায় একটি খড়ের চালের বাড়ি রাধারানিদেবীর নামে কিনেছিলেন রামকিঙ্কর। সেটাই পরে দোতলা হয়। অনেক ভাস্কর্য সৃষ্টির সাক্ষী এই বাড়িটি এখনও রয়েছে।
রামকিঙ্করের জীবনের নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন রাদারানিদেবী। দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সামনে আজও আছে ২১ ফুটের সেই যক্ষ-যক্ষীর মূর্তি। ১৯৫৪ সালে রামকিঙ্কর কুলু যাওয়ার পথে দেখলেন তাঁর পছন্দসই পাথর। ভাকড়া-নাঙাল ড্যামের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ব্লাস্ট করিয়ে পাওয়া গেল পাথরের টুকরো। ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেনে সেই পাথর আনাও ঝকমারি। বদলানো হল ওয়াগনের চেহারা। পাঠানকোটে এসে ব্রডগেজ ট্রেনে সেই পাথর আনা হল দিল্লিতে। ১৯৬৭-তে শেষ হল কাজ। রামকিঙ্কর চিঠিতে রাধারানিকে জানালেন, ‘যক্ষীটা তোমার আদলে। তোমার জন্য অনেকগুলি টাকা পেয়েছি। আমাদের বাড়ি ছেড়ে কখনও যাবে না।’
রামকিঙ্করের আঁকা রাধারানিদেবীর ছবি। ফাইল ছবি
রামকিঙ্করের জীবনের বড় ভরসা হয়ে উঠেছিলেন রাধারানিদেবী। প্রতক্ষ্যদর্শীর বিবরণে পাওযায় যায়, চিকিৎসার জন্য শিল্পীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। সে সময়েও রামকিঙ্কর শিশুর মতো কাকুতি মিনতি করেছিলেন রাধারানিদেবীর কাছে! সে কথাটাই বার বার বলতেন রাধারানিদেবী। শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে কলকাতায় এনে অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। হাসপাতালে ভাইপো দিবাকরকে দেখে তখন তিনি বলছেন, ‘ও দিবাকর, এসেছিস? ওই দিকে রাধারানির বাড়ি, ওখানে খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি চলে আয়।’ দিগভ্রান্ত তিনি, কলকাতায় খুঁজছেন রাধারানিদেবীর বাড়ি।
রামকিঙ্কর বেইজের মৃত্যুর পরে তাঁর শিল্পকর্ম বিক্রির অর্থের একটা অংশ পেয়েছিলেন রাধারানি। সে টাকায় তিনি শান্তিনিকেতনের বেশ কয়েক জনকে, বাপেরবাড়ি ভেদিয়ার কয়েক জনকে সাহায্য করেছিলেন। শেষ জীবনে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন রাধারানিদেবী। ১৯৭৮, ১৮ নভেম্বর রাধারানিদেবী, শিল্পীর করে দেওয়া ভুবনডাঙার বাড়িতেই শেষ মারা গিয়েছিলেন। শিল্পী রামকিঙ্কর আর রাধারানিদেবী প্রায়ই আসতেন অজয়ের কোলে বর্ধমানের ভেদিয়াতে। সেই স্মৃতি আজও আঁকড়ে আছে বর্ধমানের নাম।
আউশগ্রামের গবেষক