(বাঁ দিকে) ১৯২৫ সালে উত্তরায়ণে বৃক্ষরোপণ উৎসবে কবিগুরু। (ডান দিকে) জীবন দেবতায় মগ্ন রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯৫। ছবি সৌজন্য - বিশ্বভারতী
সময় বদলায়, পরিবেশ পরিস্থিতিও। কিন্তু ভাবনারা সহজে বদলায় না। এবার শান্তিনিকেতনে বাইশে শ্রাবণ বৃক্ষরোপণ হল কিন্তু তার পরের দিনই হলকর্ষণ উৎসব করা গেল না। পরিস্থিতি বিরূপ বলেই। করোনাভাইরাস বদলে দিয়েছে চিরাচরিত রীতি, ধরন সমস্ত কিছুই। তাই তিন দিন পরে যদি বা হলকর্ষণ উৎসব হল তাতে বৃক্ষরোপণের জন্য কৃষকদের গাছের চারা বিলি হল না স্বাস্থ্য ও দূরত্ব বিধি মানতে গিয়ে। কিন্তু তা বলে কি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবেশচেতনার ভাবনারা থেমে থাকবে?
বৃক্ষরোপণ উৎসব শান্তিনিকেতনে শুরু হওয়ার বাইশ বছর পরে ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকার বনমহোৎসব আরম্ভ করে। যা আজ আমাদের রাজ্যেও সাঢ়ম্বরে পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথের মতো চিরকালীন প্রাসঙ্গিক মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আর পরিবেশ নিয়ে তাঁর দূরদর্শিতা অসীম। এক সময় রাঢ় অঞ্চল ছিল লোহার গুঁড়োর আকরভূমি। তাই ‘সভ্যতার বিকাশে’ বনচ্ছেদন হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। প্রকৃতির কঙ্কালসার রূপ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গল ফাঁকা হতে থাকায় জ্বালানি কাঠের অভাব, জল শূন্যতা ও অন্যদিকে খাদ্য সঙ্কট প্রকট হচ্ছিল। পরিবেশ নিয়ে কবির ভাষণ ‘অরণ্যদেবতা’ নামে লেখা হয়েছিল। মানুষ অরণ্য সম্পদকে যেভাবে ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য হারাতে বাধ্য করছে তারই আভাস ছিল এই ভাষণে। আজ পরিবেশপ্রেমী থেকে সমাজকর্মী সমস্ত সচেতন নাগরিকের কাছে নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদ যে মাথা ব্যথার কারণ হবে তা রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন বলেই সে দিন লিখেছিলেন, ‘‘এ সমস্যা আজ শুধু এখানে নয়, মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্য সম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।... মানুষ অমিতাচারী।... মানুষ গৃধ্নুভাবে প্রকৃতির দানকে গ্রহণ করেছে, প্রকৃতির সহজ দানে কুলোয় নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তারফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে। ভূমির ক্রমিক ক্ষয়ে এই-যে বোলপুরে ডাঙার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে, বিনাশ অগ্রসর হয়ে এসেছে – একসময় এর এমন দশা ছিল না, এখানে ছিল অরণ্য – সে পৃথিবীকে রক্ষা করেছে ধ্বংসের হাত থেকে, তার ফলমূল খেয়ে মানুষ বেঁচেছে। সেই অরণ্য নষ্ট হওয়ায় এখন বিপদ আসন্ন। সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে – আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে, দিন্ তাঁর ফল, দিন্ তাঁর ছায়া।’’
জীবনশিল্পী রবীন্দ্রনাথ যা কবির চোখে দেখেছেন, অনুভব করেছেন, ব্যবহারিক জীবনে মানুষের মাঝে তার বিকাশ দেখতে চেয়েছেন বারবার। তাতেই তাঁর আনন্দ, তাতেই তৃপ্তি। তা না হলে বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ সবেতেই বৃক্ষরোপণকে উৎসবে আয়োজনে ভরিয়ে তোলার প্রয়োজনও বোধহয় ছিল না। একই সঙ্গে বৃক্ষবন্দনা করেছেন আবার তাতে উৎসবের প্রেরণাও যুগিয়েছেন। পরিবেশ শিক্ষার আদর্শ পাঠশালা গড়তে চেয়েছিলেন শ্রীনিকেতনকে। গ্রামের মানুষ, মূলত কৃষিজীবীদের উৎসাহিত করার যাবতীয় ব্যবস্থায় যে সুচারু আয়োজন তা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কারও ভাবনাতেও আসা বোধহয় অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসবে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছিলেন, ‘‘আমাদের কর্মব্যবস্থায় আমরা জীবিকার সমস্যাকে উপেক্ষা করিনি, কিন্তু সৌন্দর্যের পথে আনন্দের মহার্ঘতাকে স্বীকার করেছি। তাল ঠোকার স্পর্ধাকেই আমরা বীরত্বের একমাত্র সাধনা ব’লে মনে করি নি। ... গ্রীস একদা সভ্যতার উচ্চ চূড়ায় উঠেছিল, তার নৃত্যগীত চিত্রকলা, নাট্যকলায় সৌসাম্যের অপরূপ ঔৎকর্ষ্য কেবল বিশিষ্ট সাধারণের জন্যে ছিল না, ছিল সর্বসাধারণের জন্যে। ... যাঁরা এখানে গ্রামের কাজ করতে আসেন তাঁদের বলি, শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যেন এমন ভাবে মনে রেখে না করা হয় যে, ওরা গ্রামবাসী, ওদের প্রয়োজন স্বল্প, ওদের মনের মতো ক’রে যা হয় একটা গেঁয়ো ব্যবস্থা করলেই চলবে। গ্রামের প্রতি এমন অশ্রদ্ধা প্রকাশ যেন আমরা না করি।’’
শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের পরের দিনই শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব। এও যেন মালা গাঁথার মতোই সুচারু। গ্রাম ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন শহরের আধুনিকতার ছোঁয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষজনের মেলবন্ধন। রবীন্দ্রনাথ নিজে হিন্দু সমাজের আনুষ্ঠানিক সংস্কারবদ্ধ ধর্মকর্মে বিশ্বাস না করলেও এই সমাজকে পরিবেশ সচেতন করতে আধুনিক ভারতীয়দের জীবনে নতুনভাবে অসাম্প্রদায়িক উৎসব অনুষ্ঠানের প্রবর্তক তিনি। সাধারণ মানুষ ও কৃষিজীবীর দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ করার জন্যই বৃক্ষরোপণ ও হলকর্ষণ উৎসবের পরিকল্পনা করেছিলেন কবি। রামায়ণে আছে জনকরাজ হলচালনার সময় সীতাকে পেয়েছিলেন। রামচন্দ্রের অহল্যা উদ্ধার কৃষিপ্রশস্তি। বলরামের আরেক নাম হলধর। রবীন্দ্রনাথও গ্রাম বিকাশের উদ্যোগ নিয়ে হলকর্ষণ নামে যে উৎসবের আয়োজন করেছিলেন তা পরিবেশ সচেতনতার নামান্তরমাত্র। শ্রীনিকেতনে হলকর্ষণ উৎসব নিয়ে কবি লিখেছিলেন, ‘‘... আগুন ছিল ভারতীয় আর্যদের ধর্মানুষ্ঠানের প্রথম মার্গ। তার পর এল কৃষি। কৃষির মধ্যে দিয়ে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেছে। পৃথিবীর গর্ভে যে জনন শক্তি প্রচ্ছন্ন ছিল সেই শক্তিকে আহ্বান করেছে।’’ হলকর্ষণ উৎসবের সূচনায় পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী প্রাচীন সংস্কৃত থেকে কৃষি প্রশংসা পাঠ করেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ নিজে হলচালনা করেন। নন্দলাল বসু গোটা সভামণ্ডপকে সাজিয়েছিলেন। গ্রামের নানা সামগ্রী, শস্যদানা দিয়ে আলপনা আঁকা হয়েছিল। আর যেটা হয়েছিল সেটা প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ রক্ষায় শিল্পের আঙ্গিকে এক যুগান্তকারী কাজ। যা নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জাপান ভ্রমণের সময় শিল্প নিয়ে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘ভারতে বৃহৎ পটভূমে চিত্রাঙ্কনের প্রয়োজন। এতদিনে নন্দলাল তাহা সফল করিলেন।’ নন্দলাল বসু হলকর্ষণ উৎসবের দিনটি চিরস্মরণীয় রাখতে এবং বহির্বিশ্বের মানুষের কাছেও রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাকে পৌঁছে দিতে সেদিন শ্রীনিকেতনের একটি প্রাচীরের গায়ে হলকর্ষণ উৎসবের ফ্রেসকো করেছিলেন। যা এক অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে গিয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষের কাছে এই ফ্রেসকো শুধু শিল্প নয় পরিবেশ সচেতনতার পাঠ।
তথ্য ঋণ - রবীন্দ্র জীবনী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়,
রবীন্দ্র রচনাবলী ১৪ খন্ড, বিশ্বভারতী সুলভ সংস্করণ,
পশ্চিমবঙ্গ, রবীন্দ্র সংখ্যা, বিশ্বভারতী