Editorial News

এ দুঃসময়ও কাটবে, নতুন শিখর ধরা দেবে

পরিস্থিতি অনুকূল নয় আজ, সুসময় নয়।এক চাঞ্চল্যকর সন্ধিক্ষণকে আমরা অতিক্রম করছি। চাঞ্চল্যের এক প্রান্তে রয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ, আর অন্য প্রান্তে রয়েছে তীব্র পাকিস্তানবিরোধী আবেগ

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৩
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

পরিস্থিতি অনুকূল নয় আজ, সুসময় নয়।এক চাঞ্চল্যকর সন্ধিক্ষণকে আমরা অতিক্রম করছি। চাঞ্চল্যের এক প্রান্তে রয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবোধ, আর অন্য প্রান্তে রয়েছে তীব্র পাকিস্তানবিরোধী আবেগ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ার উপক্রম যখন, তখন আশ্রয় নিতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের। তবে আজকের ভারত কোন সুপরামর্শ মানার পরিস্থিতিতে রয়েছে, কোনটা মানতে চাইছে না, তা বুঝে ওঠা ক্রমশ দুষ্কর হচ্ছে।

Advertisement

আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। ভারতবাসী এই মুহূর্তে যে সংকটকালের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়েও সুনির্দিষ্ট উপলব্ধি রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথের রচনার অংশবিশেষ তাই আমরা পুনঃপ্রকাশ করেছি। যে পরিস্থিতি আমরা আজকের ভারতে দেখছি, ঠিক সেই পরিস্থিতিরই সাক্ষী রবীন্দ্রনাথও হয়েছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ কী পরামর্শ দিয়েছিলেন তা আমরা তুলে ধরেছি। কোন পথটা বেছে নেওয়া সমীচীন হবে, তা স্থির করার ভার দেশবাসীকেই দিয়েছি।

গত কয়েক দিন ধরে কী চলছে গোটা দেশে? কোথাও কাশ্মীরের বাইরে পড়তে যাওয়া কাশ্মীরী পড়ুয়াদের হস্টেল ঘিরে ধরে তীব্র শাসানি দেওয়া হচ্ছে, কোথাও কাশ্মীরের বাইরে থাকা কাশ্মীরী যুবককে গণপ্রহারের মুখে দাঁড় করিয়ে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে বলা হচ্ছে। শুধু কাশ্মীরীরা আক্রান্ত হচ্ছেন এমন নয়, বাংলার বা দেশের নানা প্রান্তে এমন আরও অনেকে আক্রান্ত হচ্ছেন, যাঁরা উগ্র জাতীয়তাবাদে ডুব দিতে রাজি নন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই নিজের নিজের মত প্রকাশ করছেন, চলতি পরিস্থিতি নিয়ে। যাঁদের মত দেশের বর্তমান জাতীয়তাবাদের জিগিরটার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না, নানা জায়গায় তাঁদের কিন্তু বিপদে পড়তে হচ্ছে। কারও চাকরি যাচ্ছে, কাউকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

দেশে এই পরিস্থিতিটা কি আদৌ কাম্য? যা চলছে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির সঙ্গে তা কি আদৌ মেলে? শুধু সাংবিধানিক মূল্যবোধের কথা আজ বলব না। আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে এ বার প্রশ্নটা করা যাক। ভারতীয় রীতিনীতি বা ভারতীয়ত্বের মূল্যবোধ কি এই ভাবে কোনও মত চাপিয়ে দেওয়ার বা কোনও মতকে এ ভাবে কোণঠাসা করার শিক্ষা দেয়? না, ভারতীয়ত্ব সে শিক্ষা দেয় না। সে শিক্ষা দেয় না বলেই ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করেছে যুগে যুগে।

ভারতীয় সভ্যতা, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয়ত্ব— এ সবই আসলে নানা ভাবধারার এক সংমিশ্রণ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারত যেন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নানা ধারার মেলবন্ধনের এক গবেষণাগার হিসেবে কাজ করেছে। এই ভূখণ্ডে এসে মিলেমিশে একাকার হয়েছে মানবসভ্যতার নানা শাখা-প্রশাখা। তাই এই যৌগিক গঠনটার মধ্যে থেকে আচমকা কোনও একটা সর্বশক্তিমান মৌল খুঁজে বার করার চেষ্টা অর্থহীন। আজ থেকে ১১০ বছর আগে দেশবাসীকে সে কথাই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ‘পথ ও পাথেয়’ নিবন্ধ ১১০ বছর পরে এসে আজ আবার সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

মতান্তরকে আমরা সমাজে পীড়ন করিতেছি... ১১০ বছর আগে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ঠিক যেন আজকেরই কথা​

আশার কথা হল এই যে, যে পরিস্থিতির মুখোমুখি ভারত আজ হয়েছে, ১১০ বছর আগেও ভারতে সেই পরিস্থিতিই দেখতে হয়েছিল, কিন্তু সেখানেই থেমে যায়নি ভারতীয় সভ্যতার নিরন্তর ব্যাপ্তি ও আত্তীকরণের প্রক্রিয়া। গত এক শতাব্দীতে আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছি বা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছি বা সংকুচিত হয়েছি, এমন তো নয়। এই সময়টার মধ্যে নানা ক্ষেত্রে ভারত নতুন নতুন শিখর স্পর্শ করেছে, নতুন নতুন গর্বের অর্জনে পৌঁছেছে। অর্থাৎ উগ্র জাতীয়তাবাদ আমাদের প্রসারণের পথ আগলে ধরতে চেয়েছিল ১০০ বছর আগেও, কিন্তু পারেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররা এগিয়ে এসেছিলেন বিভ্রান্তির মোহমায়াজাল কাটাতে। আজ আবার নতুন অবকাশে নতুন করে বিভ্রান্তির মধ্যে এই সুবিশাল ভারতীয় জনগোষ্ঠী। আজ হয়তো রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু তাঁর শিক্ষা রয়েছে, তাঁর শতাব্দীপ্রাচীন নিবন্ধ সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা দিচ্ছে।

পুলওয়ামায় ভয়াবহ জঙ্গিহানার পরে যে পাকিস্তানবিরোধী আবেগ দেশ জুড়ে তৈরি হয়েছে, তা অস্বাভাবিক নয়। নিরন্তর সন্ত্রাসের আঘাত সহ্য করতে থাকা একটা জাতি সন্ত্রাসের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে আজ যে ভাবে ফুঁসছে, তা হওয়ারই ছিল। এর প্রতিকারও অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু আবেগ বা আক্রোশে যখন কম্পমান গোটা জাতি, সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্তগ্রহণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় না।

মনে রাখা দরকার আরও একটা কথা— ভারত কিন্তু সন্ত্রাসের সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের বিশেষত্ব হারাবে না। যে ভারতীয় মূল্যবোধের কথা বা যে ভারতীয়ত্বের কথা রবীন্দ্রনাথ ১০০ বছর আগে লিখেছিলেন তা আজ আমাদের পুনর্বার উচ্চারণ করতে হচ্ছে, সেই ভারতীয়ত্বের শিকড় আসলে ইতিহাসের আরও অনেক গভীরে। সভ্যতার নানা প্রবাহে বা জীবনের নানা ক্ষেত্রে ভারত যে সমস্ত শৃঙ্গ জয় করতে পেরেছে আজ, সেই সব জয়ের ভিতগুলো তৈরি হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে বিপুল বৈচিত্রের সমাহার ঘটাতে পারাই এ ভারতভূমির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট। বহুত্বের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোনও এক অভিন্ন বিন্দুতে পৌঁছতে পারাই ভারতীয়ত্ব। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা সে কথাই আজ মনে করিয়ে দিতে পারে আরও এক বার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement