Vice Chancellor

আশ্রমিক মানে শুধুই অধিকার আর দাবি! রবীন্দ্র-আদর্শ তো দায়িত্ববান হতে শেখায়

গাঁধীজির অনুরোধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সংসদে আইনের মাধ্যমে বিশ্বভারতীকে জাতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করেন এবং এই বিশ্বভারতীকেই প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তকমা দেওয়া হয়।

Advertisement

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

উপাচার্য, বিশ্বভারতী শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:১১
Share:

গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গাঁধীজির কাছে দুঃখ করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সোনার সৃষ্টি বিশ্বভারতীকে রক্ষা করা যাবে না। ফাইল চিত্র।

বিশ্বভারতীর ইতিহাস ঘাঁটলে অনেক চিত্তাকর্ষক তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। যার অনেক কিছুই জনসমক্ষে আসে না। নোবেল চুরি হলে খবরের কাগজে প্রধান খবর হয়— স্বাভাবিক কারণেই উপাচার্যকে কাঠগড়ায় তোলা হয়। যদিও নিরাপত্তার জন্য একদল আছেন, যাঁরা বিশ্বভারতীর থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পান। কিন্তু বাঙালিরা আত্মতৃপ্তি পান, কারণ এর ফলে উপাচার্যকে খুব সহজেই দোষী সাব্যস্ত করা যায়। যদিও যে কোনও নিরাপত্তাজনিত গাফিলতি করার পরও, একদল প্রতি মাসে বেতন পান। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে— নিরাপত্তার গাফিলতির জন্য যাঁরা দোষী তাঁদের যখন নিলম্বিত করা হয়, তখন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা হস্তক্ষেপ করেন যাতে তাঁদের আবার বহাল করা হয়। অর্থাৎ দায়ভার কেউ নেবেন না। বেচারা উপাচার্য যিনি বিশ্বভারতীর কর্ণধার। তাঁকে সাহায্য করার জন্য সরকার বিশ্বভারতীতে চাকরিরত সবাইকে মাসিক বেতন দেন। অথচ সমস্যা হলে যাঁরা বিশ্বভারতীতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁদের ছাড়ার জন্য উপাচার্যর উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। অথচ যখন উপাচার্যকে সমস্ত দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়, তখন এই সমস্ত বঙ্গপুঙ্গবরা ধেই ধেই করে নাচেন এই ভেবে— যাক একটা গিনিপিক পাওয়া গিয়েছে।

Advertisement

আরও একটা বক্তব্য রেখে আমি মূল বক্তব্যে যাব। আশ্রমের প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গাঁধীজির কাছে দুঃখ করেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সোনার সৃষ্টি বিশ্বভারতীকে রক্ষা করা যাবে না। সবাই জানেন গাঁধীজির অনুরোধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সংসদে আইনের মাধ্যমে বিশ্বভারতীকে জাতীয় স্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান (Institute of National Importance) ঘোষণা করেন এবং এই বিশ্বভারতীকেই প্রথম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় তকমা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হতেও রাজি হলেন। যে পরম্পরা আজও চলেছে। যদিও এক আধবার তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এখন আমার প্রশ্ন— কেন গুরুদেব এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন মহাত্মার কাছে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত্‌ সম্বন্ধে তিনি কোনও ভরসা পাচ্ছেন না! যদিও তাঁর সময়ের অধ্যাপক, অধ্যাপিকাদের তিনিই চয়ন করে এনেছিলেন। তা হলে কেন এই আশঙ্কা! তিনি কি এমন কিছু আশ্রমিকদের মধ্যে দেখেছিলেন বা আশ্রম সম্বন্ধে জেনেছিলেন যা তাঁর মনে এই ভাবনার উদ্রেক করেছিল। পাঠকরা এর বিচার করুন। তবে আমি একটা ঘৃণ্য ঘটনার উল্লেখ করে আলোচনার মূল জায়গায় যাব। বিশ্বভারতীর প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা, যিনি কলকাতা থেকে এসেছিলেন, সেই গুরুদেবের একমাত্র জীবিত ওয়ারিশ, তাঁর বড়পুত্র শ্রী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য হন, যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা পায়। তৎকালীন নথিপত্র থেকে এটাও পরিষ্কার যে এটা অনেকেই চাননি। আজকের যে প্রথা অর্থাৎ সব অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী, পরিদর্শক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীমহোদয়কে পাঠানো হয় তখনও তাই হয়েছিল। একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কবিপুত্রকে বিশেষ বিব্রত করা হয়েছিল। তার পুরোভাগে ছিলেন তৎকালীন আশ্রমিকরা যাঁরা গুরুদেবের স্নেহধন্য ছিলেন। রথীন্দ্রনাথকে উপাচার্য পদ ছাড়তে বাধ্য করা হল। তিনি দেহরাদূনবাসী হলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৬১ সালে গুরুদেবের জন্মশতবর্ষে, তাঁর একমাত্র জীবিত সন্তানকে ডাকা হল না। তিনি কলকাতায় বসে পিতৃদেবের উদ্দেশে স্মৃতিতর্পণ করেন কিছু শুভানুধ্যায়ীকে সঙ্গে নিয়ে। অতএব আজকে আশ্রমিকরা যে ঐতিহ্যের কথা বলেন, সেই ইতিহাসে এই জঘন্য ঘটনাকে কি ভোলা যায়। অদ্ভুত ব্যাপার, বিশ্বভারতীর প্রবৃত্তিতে তেমন কোনও তারতম্য ঘটেনি। যা আগে বলেছি।

বারবার জনসমক্ষে আনার পর যারা রবীন্দ্রনাথের জন্য মেকি কান্নায় মানুষকে প্রভাবিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন তাঁদের মন তখন কাঁদে না। ফাইল চিত্র।

Advertisement

আশ্রমিক মানে অধিকার। আশ্রমিক মানে রাবীন্দ্রিক। কিন্তু অধিকারের সাথে সাথে যে দায়িত্ব আসে, গুরুদেবের ভাবধারায় নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে লাগে, তা একেবারেই নৈব নৈব চ। গুরুদেব ৫০টা গ্রাম দত্তক নিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষের সাথে বিশ্বভারতীকে জুড়তে চেয়েছিলেন। কই, আজকে আমরা যারা আশ্রমিক বলে আকাশ বিদীর্ণ করি, অধিকার দাবি আর নিজের স্বার্থ সিদ্ধি ছাড়া আর কি কোনও কথা ভাবি? একটা উদাহরণ দিই— এই অতিমারির সময় বিশ্বভারতী প্রায় তিন মাস (এপ্রিল-জুন) মূলত আদিবাসী গ্রামগুলোতে ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আমরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে দেওয়া অর্থের সাহায্যে এই ত্রাণ চালাই। আমরা প্রায় ৬০০০ পরিবারকে ত্রাণসমগ্রী দিতে পেরেছি। সবাইকে আমরা অর্থ সাহায্য বা অনান্য সাহায্য দেওয়ার আবেদন করি। কই, তেমন ভাবে আশ্রমিকরা এলেন না তো! এটা গুরুদেবের ভাবাদর্শের পরিপন্থী। মনে তাই প্রশ্ন জাগে।

রবীন্দ্র-আদর্শ কী? উপরের ভূমিকার মাধ্যমে আমি কী প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের আলোচনা করব— তারই একটা লম্বা বিবরণ। এ বারে মূল প্রশ্নের আলোচনায় আসি। প্রথমেই বলে রাখি যে আমি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নই। তাই অনেকের কাছে এটা অনধিকার চর্চা মনে হতে পারে। তবে এটা বলতে পারি যে আমি রবীন্দ্রানুরাগী। এ ছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের ভাবনাচিন্তা নিয়ে গবেষণা করছি। যার ফল এ বছরের শেষে পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পারব আশা রাখি। দ্বিতীয়ত, এই লেখাটার ভিত্তি আমার ভাবনাচিন্তা যা তৈরি হয়েছে তা গুরুদেবের লেখনি পড়ে। আমি অবশ্য পাঠককে ভারাক্রান্ত করব না মূল লেখা থেকে লম্বা উদ্ধৃতি করে। আমি চেষ্টা করব সাদামাটা ভাষায় আমার চিন্তায় রবীন্দ্র-আদর্শ কি তা ব্যক্ত করতে। আর একটা কথা, এই লেখাটা কাউকে ঠেস দেবার জন্য নয়। এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য রবীন্দ্র-আদর্শকে বোঝা, যা স্বার্থান্বেষী বা মেকি রাবীন্দ্রিকদের জন্য আজ ধ্বংসের পথে। রবীন্দ্রনাথ আজ পণ্য। কোনও ভাবাদর্শ নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের মূর্তি স্থাপনা করে বিশ্বভারতীর জায়গা হরফ করা হয়। বারবার জনসমক্ষে আনার পর যারা রবীন্দ্রনাথের জন্য মেকি কান্নায় মানুষকে প্রভাবিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন তাঁদের মন তখন কাঁদে না। কারণ এতে বিশ্বভারতীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে কিন্তু তথাকথিত আশ্রমিক বা রাবিন্দ্রিকদের স্বার্থে আঁচ লাগে না। এই ভাবে দিনের পর দিন বিশ্বভারতীর জমি কব্জা হয়ে যাচ্ছে জমি-হাঙরদের দৌরাত্মে। একটা হিসেবও পাওয়া যায়। ৭০ একরের বেশি জমি ব্যক্তিগত মালিকানায় জবরদস্তি করে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বভারতীর মধ্যে লিজ দেওয়া বাড়িগুলোও হস্তান্তরিত হচ্ছে। অদ্ভুত ব্যাপার, এর মধ্যে অনেক বাড়ি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্মের জন্য। যা নিয়ে আশ্রমিকদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। এ ছাড়া এ সমস্ত বাড়িগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম ব্যতিরেকে মালিকানা পাল্টে যাচ্ছে। তার জন্য বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষর কাছে প্রায়শই তদ্বির আসে। যেহেতু তদ্বির শোনা হয় না, তার খেসারত দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। কারণ তদ্বির না শুনলে তাঁরা যে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। অতএব এটা আমাদের অবাক করে না, যখন কর্তৃপক্ষের প্রায় সবার বিরুদ্ধে মিথ্যা এফআইআর করা হয়। হয়ত বা ভীতি সঞ্চালনের জন্য এটি প্রথম পদক্ষেপ। ১৭ অগস্টের ধুন্ধুমার কাণ্ড আর একটা প্রতিফলন। আমার স্ত্রীকে সব্জিবাজারে বাইক চালকের ধমকি, আমাদের মহিলা সহকর্মীকে অ্যাসিড ছোড়ার ধমকি এগুলো ওই একই গল্পের বিভিন্ন প্লট। এত সমস্ত জানার পরই যখন আশ্রমিকরা একটা কথা ব্যয় করেন না তখন সত্যিই অবাক লাগে যে এটা কি রবীন্দ্রআদর্শের অনুকূল? কারণ গুরুদেব সব সময় বিপর্যস্ত মানুষজনের সাথে নিজে ছিলেন এবং তাঁর ভাবাদর্শের একটা বড় সোপান যা তিনি ‘প্রভাত উৎসব’ কবিতায় সোচ্চারে বলেছিলেন—

“হৃদয় আজ মোর কেমনে গেল খুলি।

জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি।

ধরায় আছে যত মানুষ শত শত

আসিছে প্রাণে মোর, হাসিছে গলাগলি।“

আশ্রমিক মানে অধিকার। আশ্রমিক মানে রাবীন্দ্রিক। ফাইল চিত্র।

এখানে রবীন্দ্রনাথ প্রতিপালক। যিনি ছুটে যান যখন ১৮৯৮ সালে কলকাতায় গ্লেগ মহামারি দেখা দেয়। উনি রাস্তায় নামেন প্লেগ আক্রান্ত মানুষদের ত্রাণের জন্য অর্থ জোগারের উদ্দেশ্যে। উনি রাস্তায় নামেন লোকজনকে বোঝানোর জন্য যে প্লেগের টিকা সবার জন্য মঙ্গলময়। এখানে গুরুদেবের কার্যাবলীর সঙ্গে অন্য এক মহামানবের প্রচেষ্টার মিল পাই। তিনি হলেন, ইটালির বিখ্যাত শিল্পী লিয়োনার্দো দ্য ভিঞ্চি, যিনি চোদ্দ-পনেরো শতকে যখন ইটালি প্লেগে আক্রান্ত তখন মিলানের শাসক লুদোভিচের অনুরোধ সত্ত্বেও শহর ছাড়েননি। এবং প্লেগে আক্রান্ত মানুষের পাশে সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে নির্ভয়ে দাড়িয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে কলকাতা যখন প্লেগ মহামারিতে বিপর্যস্ত, তখন গুরুদেব এই একই ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ছাড়া সরকার যে পর্যাপ্ত সাহায্য করছেন না, তার বিরুদ্ধে লেখনি ধরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তার ‘ভারতী’তে প্রকাশিত প্রবন্ধের উল্লেখ করা যেতে পারে। কবির ধারণায় মানুষের উৎসব সেই দিন যেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ। তিনি ‘উৎসবের দিন’ লেখাতে আরও বলেন, “যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি,... যেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না, সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না।” তাই মর্মাহত কবি সজনীকান্ত দাশকে কোন একটা সাক্ষাৎকারে বলছেন, “একটা বড় আশ্চর্য জিনিস দেখছি এই বাংলাদেশে, যে সব পুরুষ এখানে দেশনেতার সম্মান লাভ করেন, নিম্নশ্রেণীর মেয়েদের ঘর ভাঙাভাঙির খেলাকেই তাঁরা উচ্চ রাজনীতি বলে ঘোষণা করেন। তাদের পুরুষত্বে এতটুকু বাঁধে না। এখানকার লোক তাই তিলে তিলে কিছু গড়ে তোলবার জন্য দল বাঁধে না, দল বাঁধে গড়া জিনিসকে ভাঙবার পৈশাচিক আনন্দে। এ জিনিসকেও ক্ষমা করা যেত, যদি না দেখতাম পিছনে ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধি তার দংস্ট্রা বের করা আছে।” (সজনীকান্ত দাশ— কর্মী রবীন্দ্রনাথ, পাতা ২৭)।

এর থেকে পরিষ্কার করে আর বোধ হয় বলা যায় না। বিশ্বভারতীতে যে সমস্ত ভাল কাজে হাত দেওয়া হচ্ছে সে সমস্ত ভণ্ডুল করাই মূল উদ্দেশ্য। এখানে আশ্রমিকরা জোটবদ্ধ হলে তাদের স্বার্থের জন্য একত্রিত হন এবং বিশ্বভারতীর প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন বা যারা আইনের রক্ষক তাঁরাই ভক্ষক হয়ে ওঠেন বা জনপ্রিয় নেতানেত্রী ১৭ অগস্টের ধুন্ধুমার কাণ্ডের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। এগিয়ে আসেন ভোটে জেতা জনপ্রতিনিধি। দাবি করেন তিনি যেহেতু প্রাক্তনী, তাই এই কুকার্যে অংশ গ্রহণ করা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। নিশ্চয় তাই। কারণ কবিগুরু সজনীকান্ত দাশকে এই কথাই দ্বর্থ্যহীন ভাষায় বলেছেন। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি যে যাঁরা আশ্রমিক বা নিজেদের রবীন্দ্রপ্রেমিক বলে দাবি করেন তাঁরা আশ্রমের সাপ্তাহিক উপাসনায় কখনও কি আসেন বা যদি আসেন, বছরে কবার আসেন! কতজন এই সমস্ত মেকি রাবীন্দ্রিক বৈতালিকে যোগদান করেন! কতজন হলকর্ষণ বা বৃক্ষরোপনে আসেন! কতজন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী ফাণ্ডে দান দেন! বলতে লজ্জা হয় যে, সবচেয়ে পুরোনো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে না আছে কর্পাস ফান্ড, না আছে অ্যালামনি ফান্ড। কই, আশ্রমিকরা এগুলো নিয়ে ভাবেন না তো! উপাচার্যকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করা এবং যখন প্রশাসনের নিরপরাধ কর্মীরা অহেতুক ভাবে সারা দিন ধরে বিপর্যস্ত থাকেন, যখন আইনের রক্ষকরা তাদের জেরা করেন, কই তখন তো কোনও প্রতিবাদ হয় না।

কবির ধারণায় মানুষের উৎসব সেই দিন যেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ। ফাইল চিত্র।

এটা ঠিক যে বিশ্বভারতীর শত্রুসংখ্যা বাড়তে থাকে ২০১৯ সালের পৌষমেলার পর থেকে। জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশক্রমে এবং আচার্যের সহায়তায় আমরা সফল হয়েছিলাম মেলা চারদিনে বন্ধ করতে। বিদূষণ অনেক কম হয়েছিল, যদিও রাজ্য বিদূষণ পর্যদ বিশ্বভারতীকে ১০ লাখ জরিমানা করেছে। তখন থেকেই ব্যবসায়ী সমিতি এবং স্থানীয় স্বার্থান্বেষীদের আমরা চক্ষুশূল হয়ে গেলাম। একটা উদাহরণ দিই যে কী ধরনের অনিয়ম করে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা (অবশ্যই জেলা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তির মদত থাকে এমন প্রমাণ আছে) এক-একজন একের অধিক পৌষমেলায় দোকান নিয়েছিলেন। নিয়ম হয়েছিল যে একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে অনলাইন একটাই স্টল নেওয়া যাবে। কিন্তু লিস্ট পরীক্ষা করে দেখা গেল যে ৬ জন ৬৪টা স্টল বুক করেছেন নিয়ম ভেঙে। যাঁরা প্রমাণ চান তাদের অনুরোধ করি যে আপনারা অনুগ্রহ করে বিশ্বভারতীর ওয়েবসাইটটা দেখুন। সেখানে নাম উল্লেখিত আছে। চোখের নজর যাতে না এড়ায় তাই ঐ নামগুলোকে লাল কালি দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। এটা শুধুমাত্র বিরাট হিমশৈলের চূড়া। কিছু আমি আমার সাপ্তাহিক বার্তায় উল্লেখ করেছি।

এখন প্রশ্ন, তা হলে বিশ্বভারতীর ভবিষ্যৎ কী? এটা মনে রাখা দরকার যে বিশ্বভারতী একটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে উপাচার্য নিযুক্ত করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দফতরের মতামতই স্বতঃসিদ্ধ। উপাচার্য আসেন বাইরে থেকে, অন্তত এখনও পর্যন্ত। আমি জার্মানিতে হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যপনা করাকালীন এই দায়িত্ব পাই। আমি এখানে একাই থাকি। প্রায়ই অসম্মানের সম্মুখীন হতাম, কিন্তু এখন জীবনের ধমকি পাচ্ছি। কয়েক দিন আগে আমার স্ত্রীকে বলা হয় আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তা না হলে যে কোনও কিছু ঘটে যেতে পারে। জানি না রবীন্দ্র-আদর্শে যাঁরা অনুপ্রাণিত বলে দাবি করেন তাঁরা কী বলবেন। যদিও গুরুদেব সজনীকান্ত দাশকে সাক্ষাৎকারে (উপরোক্ত) এই আশঙ্কা করেছিলেন যে ব্যক্তিগত স্বার্থবুদ্ধি যখন তার দংস্ট্রা বের করে তার পরিণাম বিধ্বংসী।

বসন্ত তাণ্ডব (বসন্ত উৎসব নয়) বা পৌষ মেলার স্টল বিতরণে যে দুর্নীতি হয় তা বন্ধ করার ফলে আজ বিশ্বভারতী এক বিপর্যয়ের মুখে। ফাইল চিত্র।

পরিশেষে একটা আবেদন দিয়ে শেষ করব এই প্রতিবেদন। রবীন্দ্র-আদর্শ যে বিকৃত করা হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই বসন্ত তাণ্ডব (বসন্ত উৎসব নয়) বা পৌষ মেলার স্টল বিতরণে যে দুর্নীতি হয় তা বন্ধ করার ফলে আজ বিশ্বভারতী এক বিপর্যয়ের মুখে। যাঁরা সত্যিই রবীন্দ্র-আদর্শে বিশ্বাস করেন, তাঁরা নিশ্চয় আমার মতই বা আমার থেকে বেশি দুঃখী। একটা মন্তব্যের উল্লেখ করব— এই পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত মুখ আমাকে গত সপ্তহে হোয়াটসঅ্যাপে একটা বক্তব্য জানিয়েছেন, যেটা আমি পাঠকের কাছে তুলে ধরব। আমি নাম উল্লেখ করতে পারব না, কারণ রাজ্যে এই ভয়ের বাতাবরণে তিনিও ভীত। তাই তাঁর নামটা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “বিদ্যুৎবাবু বিশ্বভারতীর উন্নতির জন্য যে সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা প্রশংসার যোগ্য। তবে এই সমস্ত করার জন্য যে অপমান এবং অবমাননার সম্মুখীন আপনি তার জন্য সহৃদয় বাঙালির হয়ে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।” এটাই আমার পাথেয়। গুরুদেবের আদর্শ আমার কাছে আগে চলার আলো ও দিশা। বিশ্বাস করি যাঁরা প্রাণের অধিক ভালবাসেন গুরুদেবের ভাবধারা, তাঁরা নিশ্চয় সামনে আসবেন। সব কিছু ভয়-ভীতি পরিত্যাগ করে। সে দিন হবে মনুষ্যত্বের জয়, বাজবে বিজয় ডঙ্কা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement