কী অনায়াসে পাঁচিল টপকে গেল সিবিআই!

পাঁচিল টপকে সিবিআই তার পারদর্শিতা দেখাল। কিন্তু অন্য কোনও পাঁচিলে তা ধাক্কা খাবে না তো? গোয়েন্দা সংস্থার অতি সক্রিয়তা ও অতি নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন দেবজ্যোতি কর্মকারপ্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদম্বরমকে গ্রেফতার করতে সিবিআই কর্তারা তাঁর বাড়িতে ঢুকতে বাধা পেলে অবশেষে তাঁরা পাঁচিল টপকেই বাড়িতে ঢুকলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:১০
Share:

— ফাইল চিত্র।

অবশেষে পাঁচিলও টপকে গেলেন! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এটাই। গল্পের গরু গাছে উঠলে যেমনটা মনের মধ্যে হয় আর কী, অনেকটা সে রকমই এক দৃশ্য দেখল তামাম দেশ। আমিও দেখেছি। আশা করি আপনিও। বিশ্বাস করুন, যেন হিন্দি সিনেমারই একটি জ্বলজ্বলে দৃশ্য দেখছি মনে হচ্ছিল। অবশ্য গায়ে চিমটি কাটার প্রয়োজন হয়নি। কারণ, ততক্ষণে টিভির চ্যানেলগুলো ঘুরে এসেছি বেশ কয়েক বার। সর্বত্র একই হেডলাইন— ‘প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে গ্রেফতার করতে সিবিআই আধিকারিকেরা পাঁচিল টপকে গেলেন!’

Advertisement

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদম্বরমকে গ্রেফতার করতে সিবিআই কর্তারা তাঁর বাড়িতে ঢুকতে বাধা পেলে অবশেষে তাঁরা পাঁচিল টপকেই বাড়িতে ঢুকলেন। প্রথমত আমাদের মতো এই গণতান্ত্রিক দেশে আজ পর্যন্ত কেউ এ দৃশ্য দেখেছেন কিনা জানি না। আমার এই অতিসংক্ষিপ্ত জীবনে যে অন্তত দেখিনি এটুকু বলতে কোনও দ্বিধা নেই। যাই হোক, পাঁচিল ডিঙিয়ে যেতে যে শারীরিক কসরত করতে হয় এবং তার সক্ষমতা যে সিবিআই কর্তাদেরও আছে এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। তবে সন্দেহ ছিল ভারতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি। এবং সন্দেহাতীত ভাবে এই সন্দেহ এখনও আছে। আরও স্পষ্ট করেই বলি, তীব্র ভাবে সন্দেহ এবং ঘৃণাও আছে। যে সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর মধ্যে পড়ে আমরা অসংখ্য মানুষ ছটফট করতে করতে হীনমন্যতায় ভুগছি। এমনই অবস্থা যে, অসহায় হয়ে এখন গোঙানো ছাড়া আর কিছু করারই ক্ষমতা নেই আমাদের। ভারতীয় গণতান্ত্রিক এই পরিবেশের প্রতি আমার এই তীব্র ঘৃণার কারণ অনেক। তবে সংবিধান এবং তার আলঙ্কারিক বিধি-বিধান মেনে নিয়েই বলতে বাধ্য হচ্ছি এই লোকদেখানো গণতন্ত্রের প্রচ্ছদ এ বার সত্যিই পরিবর্তন করা দরকার। দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং তার প্রচ্ছদ রচনায় যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এই আফসোস আমার। আসলে সেই সব প্রচ্ছদ শিল্পীরা যাঁরা গণতন্ত্রের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন, তাঁরা কি তখন জানতেন তাঁদেরই তৈরি করা, আঁকা নিয়মগুলো কী ভাবে প্রতি দিন নিয়ম করে অনিয়মের হাওয়ায় উড়ে যাবে, আর আপামর ভারতবাসীর স্বপ্নকে ক্ষুণ্ণ করবে?

সিবিআই কর্তাদের এই যে হঠাৎ হঠাৎ করে লাফিয়ে ওঠা এবং কখনও কখনও সে লাফ এতটাই, যেন লম্বায় প্রায় এক তলা বাড়ির কাছাকাছি পাঁচিলকেও হার মানায়। এমনিতেই বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা এই দৃশ্য দেখতেই অভ্যস্ত, যেখানে কোনও একটি মামলা এবং তা পরবর্তীতে সিবিআইয়ের হাতে ন্যস্ত হয়েছে আর তার গতিপ্রকৃতিও অদ্ভুত রকমের হয়ে গিয়েছে। কখনও প্রচণ্ড ভাবে দৌড়চ্ছেন তো কখনও শীতঘুমে আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে সিবিআই কর্তাদের। আর রাজনৈতিক নেতাদের তো যে কোনও মামলাতে জিজ্ঞাসাবাদ করাটাই কঠিন কাজ। মন্ত্রী হয়ে গেলেই যেন সাত খুন মাফ, যদি তিনি শাসক দলের মন্ত্রী হন।

Advertisement

সিবিআইয়ের এই ‘কচ্ছপ-দৌড়’ শেষ পর্যন্ত গল্পের মতো খরগোশকে হারিয়ে সাফল্য লাভ করবে কি না তার উত্তর জানা নেই। তবে উত্তরের অপেক্ষায় আছি আমরা সবাই। একমাত্র তদন্তেই উঠে আসবে সত্যিই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দোষী কি না। বলা বাহুল্য, এর উত্তর জানাটাও আমাদের অধিকার।

আর যাইহোক সিবিআই এই ভাবে গতিপ্রাপ্ত হওয়াতে আমি খুশিই। বিশেষ করে যদি আগামী দিনে এ রকম আরও দৃশ্য দেখি। রাজনৈতিক নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা গ্রেফতার করতে যদি সিবিআই এরকম ভাবেই নিজে থেকে সাহসী হয়ে ওঠে। কিংবা যদি এমন সত্যিই হয় যে প্রচলিত মিথ আমরা শুনে আসছি, যেখানে এক জন রাজনৈতিক নেতা আর সাধারণ মানুষের বিস্তর তফাত। এই মিথ যদি ভেঙে দেওয়া যায়, আমি সত্যিই খুশি হব। কিন্তু পাশাপাশি প্রশ্ন জাগে এই গতি ঠিক কত দিনের জন্য?

দেশের আরও যে সব মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এবং যেখানে তদন্তের নামে দীর্ঘ দিন ধরে নানা নাটকীয় দৃশ্য দেখে আসছি আমরা, সে সব ক্ষেত্রে সিবিআই কি আদৌ গতিশীল হবে? এ ক্ষেত্রে সিবিআই না হয় পাঁচিল টপকে গেলেন কিন্তু যে সব ক্ষেত্রে কোনও পাঁচিলই নেই? সেখানে কোন অদৃশ্য পাঁচিলে বারবার ধাক্কা খাচ্ছেন সিবিআই কর্তারা? দীর্ঘ দিন ধরে তদন্তের গতিপথ অনুসরণ করে করে আমরা সত্যিই আশাহত। যে লাফ তাঁরা দিয়েছেন সে ভাবেই না হয় প্রমাণিত হোক না অসংখ্য সিবিআই মামলা। শুধু মাত্র সময়ের দিকে তাকিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসেবে সিবিআই ব্যবহৃত হচ্ছে— এই অভিযোগ মানতে যে আমাদের ভীষণ কষ্ট হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তীব্র অসন্তোষের জন্ম অনেকটা এখান থেকেই। সত্যিই আমরা চাই না আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভেতরেও জন্ম নিক এই অসন্তোষ-অনাস্থার সামান্যতম রেখাও। আইন চলুক না আইনের মতো। রাজনৈতিক দলের দ্বারা সে প্রভাবিত নয় এটাই এখন প্রামাণ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তার তদন্ত অবশ্যই দরকার। ইচ্ছাকৃত ভাবে কখনও কখনও তা গতিপ্রাপ্ত হওয়া আবার কখনও তা শীতঘুমে চলে যাওয়া, যা সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ মেধায় প্রচণ্ড আঘাত হানে, তা যেন না হয়। তাতে সাধারণের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। উপশমের জন্য হা-পিত্যেশ করতে লজ্জা পাই। সে লজ্জা অবশ্যই আমার রাষ্ট্রেরই। লজ্জা গণতন্ত্রের বিজ্ঞাপন আঁকা প্রচ্ছদ শিল্পীদের এবং আমাদের গর্বের যাবতীয় পূর্বকালেরও। আমাদের উত্তরকালের কাছে মাথা নত হয়ে থাকার লজ্জাও বটে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement