প্রশ্ন: এখনকার প্রজন্মের কম্পিউটারের আয়ু আর কত দিন?
চার্লস বেনেট: গর্ডন মুর-কথিত সীমার কথা বলছেন? ওঁর ভবিষ্যদ্বাণী মানলে কম্পিউটারের ইন্টিগ্রেটেড সারকিটের মধ্যে ট্রানজিস্টার বেশি বেশি করে ভরে দেওয়ার একটা সীমা অবশ্যই আছে। সে হিসেবে এখনকার কম্পিউটার ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছবেই এক দিন। তবে আমি বলতে পারব না সে দিনটা কবে আসবে।
প্র: এর পরেই কি আসছে কোয়ান্টামের যুগ?
উ: বিজ্ঞানে অগ্রগতি আসে তিলে তিলে। রাতারাতি কিছু হয় না। মৌলিক আবিষ্কার প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হতে সময় লেগে যায়। অ্যালান ট্যুরিং সেই কবে ইউনিভার্সাল কম্পিউটারের আইডিয়া দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা কী? আমি এখন যে কোনও প্রোগ্রাম কিনে নিয়ে আমার ল্যাপটপে চালাতে পারি। এইটেই ইউনিভার্সাল কম্পিউটারের মূল কথা। অথচ, ট্যুরিং যখন তাঁর পেপার লিখলেন, তখন তা এত জটিল মনে হল অনেকের কাছে যে, ওরা তাকে পাত্তা দিলেন না। তথ্য নাড়াচাড়া করেন যে সব গবেষক, তাঁরা বহু কাল পদার্থবিদ্যাকে ব্রাত্য করে রেখেছিলেন।
প্র: কোয়ান্টামের কোন কোন মাহাত্ম্যে পাল্টে যেতে পারে কম্পিউটার বিজ্ঞান? আসতে পারে নতুন ধরনের কম্পিউটার?
উ: কোয়ান্টামের জগৎ আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার দুনিয়া থেকে আলাদা। অভিজ্ঞতায় আমরা জানি কোনও বস্তু কোনও নির্দিষ্ট সময়ে একটামাত্র দশায় থাকতে পারে। কোয়ান্টামের দুনিয়ায় কিন্তু বস্তুটা একই সঙ্গে অনেক দশায় থাকে। এটাকে বলে সুপারপজিশন। এই সুপারপজিশন কোনও কম্পিউটারের ক্ষমতা এক লাফে বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। এখনকার কম্পিউটার ধাপে ধাপে কাজ করে এগোয়। এক এক ধাপে তার এক এক দশা। কোয়ান্টাম-নির্ভর কম্পিউটারে প্রতি ধাপে তা একের বদলে একসঙ্গে বহু দশায় থাকতে পারবে। বহু দশা মানে বেশি কাজ। বেশি ক্ষমতা। প্রসেসর একটা হলেও, এই যে তার সমান্তরাল ভাবে অনেক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, এটাই কোয়ান্টামের আশীর্বাদ। কোয়ান্টামের আরও এক বাহাদুরি, যা আলবার্ট আইনস্টাইনের মোটেই পছন্দ ছিল না, তার পোশাকি নাম এন্টাংগলমেন্ট। দুটো কণার মধ্যে এক ধরনের অতিন্দ্রীয় গাঁটছড়া। এমন সম্পর্ক যে, একটার খবর অন্যটা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারে। খবর পৌঁছতে কোনও সময় লাগে না। তা কণা দুটোর দূরত্ব যা-ই হোক না কেন। মানতে না পেরে এ ব্যাপারটাকে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘দূর থেকে ভুতুড়ে যোগাযোগ’। সত্যিই, এ যোগাযোগের কোনও ব্যাখ্যা নেই। তবে, ভুতুড়ে হোক বা অন্য কিছু, ওই গাঁটছড়া কিন্তু কোয়ান্টামের আর এক আশীর্বাদ, যা কাজে লাগবে নতুন কম্পিউটারে। কারণ, এর সাহায্যে মুহূর্তে বিভিন্ন দশার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।
প্র: বেঁচে থাকলে গবেষকদের তরফে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর উদ্যোগ দেখে আইনস্টাইন কী বলতেন?
উ: জীবিত থাকলে আইনস্টাইনের বয়স হত প্রায় ১৪০। পুরনো মতামত কেউ পাত্তা দিত বলে মনে হয় না। তবে, আমার ধারণা কোয়ান্টামের এক ব্যাখ্যা আইনস্টাইনের পছন্দ হত। যা ছাপা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর। ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলেন হিউ এভারেট। দিয়েছিলেন কোয়ান্টামের এক ধাঁধা নিরসণে। ধাঁধাটার নাম ‘মেজারমেন্ট প্রবলেম’। সমস্যাটা ওই যেমন আগে বলেছি। কোয়ান্টামের দুনিয়ায় একটা কণা থাকতে পারে একসঙ্গে নানা দশায়। একটা ইলেকট্রন। সে একসঙ্গে থাকতে পারে ‘ক’ এবং ‘খ’ বিন্দুতে। কিন্তু যখন তাকে শনাক্ত করা হচ্ছে, তখন সে ধরা পড়ছে একটা বিন্দুতে। হয় ‘ক’, নয় ‘খ’ বিন্দুতে। এই যে শনাক্ত হওয়ার আগে একাধিক দশা, আর শনাক্ত হওয়ার মুহূর্তে সে সব দশা থেকে একটামাত্র দশায় পৌঁছনো, এটা মেজারমেন্ট প্রবলেম। বহু দশা থেকে এক দশায় পৌঁছনোর ধাঁধা সমাধানে এভারেট তাঁর ব্যাখ্যা পেশ করেছিলেন। তাঁর মতে, শনাক্ত করার কাজটা ব্রহ্মাণ্ডকে শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত করে দেয়। যেমন, একটা ব্রহ্মাণ্ডে ওই ইলেকট্রন কণাটা থাকে ‘ক’ বিন্দুতে। আর একটা ব্রহ্মাণ্ডে তা থাকে ‘খ’ বিন্দুতে।
প্র: এভারেট-এর ওই ব্যাখ্যা কারও কারও খুব পছন্দ। যেমন, অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী ডেভিড ডয়েশ। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বহুগুণ বেশি ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে তিনি ধার করেছেন এভারেট-এর তত্ত্ব। বলেছেন, একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার নাকি অনেকগুলো বিশ্বে অনেকগুলো কম্পিউটার বনে যায়। আর সেগুলো নাকি কাজ করে চলে পাশাপাশি।
উ: হ্যাঁ, তবে ওটা কিন্তু কোয়ান্টামের মূল ধারার ব্যাখ্যা নয়। বহুবিশ্ব তত্ত্ব সকলে মানেন না।
প্র: বিজ্ঞান লেখক আইজাক আসিমভ একদা বলেছিলেন, যে কোনও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেন ম্যাজিক। কোয়ান্টাম কি ম্যাজিক?
উ: আসিমভ ছিলেন মূলত কল্পবিজ্ঞান লেখক। ওঁর কাছে ম্যাজিক বা রহস্যের মূল্য অবশ্যই ছিল বড়। আমি মনে করি গবেষণার উদ্দেশ্য উল্টো। রহস্যকে ম্যাজিক আখ্যা না দিয়ে তা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করা উচিত।
প্র: পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম কম্পিউটার কবে তৈরি হবে? কবে তা বাজারে আসবে? বহু বছর ধরে শোনা যাচ্ছে তার আবির্ভাব নাকি এক দশক দূরে। ওই এক দশক সময়টা তো আর কমছে না। কত দিন কোয়ান্টাম কম্পিউটার এক দশক দূরের জিনিস হয়ে থাকবে?
উ: একাধিক সংস্থা তো প্রোটোটাইপ কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানিয়ে ফেলেছে। এটা ঠিক যে, বাজারে হুহু করে বিক্রির মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখনও বেরোয়নি। কিন্তু যে ভাবে অনেকে তার পিছনে ছুটছে, তাতে তেমন কম্পিউটার তৈরি হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। দেরি নিয়ে অভিযোগ? সেটা বিজ্ঞানের কোন উদ্যোগ নিয়ে নেই বলতে পারেন? ওই যে ফিউশন পাওয়ার— পরমাণু-পরমাণু জোড়া লাগিয়ে সূর্য যে ভাবে প্রচণ্ড এনার্জি উৎপাদন করছে— তা পৃথিবীর চুল্লিতে উৎপাদনের চেষ্টাও তো বিজ্ঞানীরা বহু দিন ধরে করছেন। এখনও সে কাজে সফল হননি। না-ই বা হলেন। তাতে কী আসে যায়। বহু কাল ব্যর্থতার পরেও হাল যে ছাড়েননি, সেটাই তো বড় কথা।
(চলবে)
সাক্ষাৎকার: পথিক গুহ