ফাইল চিত্র।
রাজনৈতিক চাপান-উতোর, নাগরিক তরজা, আদালতের নির্দেশ— পূজার আগে সবই এমন একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করিয়া চলিল, আপাতদৃষ্টিতে যাহাকে স্বতঃসিদ্ধ বলিয়া ভ্রম হইতে পারে। প্রশ্নটি হইল: কোভিড-১৯’এর বিপদটিকে মাথায় করিয়া প্রতিমাদর্শন করিব কি না। মনে হওয়া স্বাভাবিক, যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের নিকটই এই প্রশ্নের একটিই উত্তর সম্ভব: না, এই বৎসর দুর্গাপূজা ঘরেই কাটাইব। বাস্তব বলিতেছে, এই পূজায় যত মানুষ পথে নামিলেন, প্যান্ডেলে গেলেন, কেনাকাটা করিলেন, রাস্তায় আইসক্রিম খাইলেন বা সিগারেটে সুখটান দিলেন, তাঁহাদের সংখ্যা যথেষ্ট কম। এই মানুষগুলিকে কাণ্ডজ্ঞানহীন বলিয়া দিলে অল্প কথায় সমস্যা মিটিয়া যায়, কিন্তু এই প্রশ্নের সদুত্তর মিলে না যে কেন বিপদের প্রবল ঝুঁকি অগ্রাহ্য করিয়াও তাঁহারা আঁজলা ভরিয়া আনন্দ তুলিয়া আনিতে গেলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে লিখিতেছেন, মানুষ রাস্তায় না নামিলে, কেনাকাটা না করিলে বহু মানুষের রুজিরুটি বন্ধ হইয়া যাইবে। কথাটা বিলক্ষণ সত্য, কিন্তু নিয্যস পরহিতৈষণা দ্বারা তাড়িত হইয়াই মানুষ বিপদ মাথায় করিয়া রাস্তায় নামিতেছেন— এতখানি মানিয়া লইতেও অসুবিধা হওয়া স্বাভাবিক। সত্য এই যে, মানুষ আনন্দের খোঁজেই রাস্তায় নামিতেছেন।
ভাল থাকা, আনন্দ, বা দুঃখের ন্যায় অনুভূতিগুলিকে যদি অর্থশাস্ত্রের চশমা চোখে আঁটিয়া দেখা হয়, তবে অন্য পাঁচটি অর্থনৈতিক পণ্যের ন্যায় এই অনুভূতিগুলিরও গুরুত্ব হইল, তাহারা ইউটিলিটি বা উপভোগ তৈরি করে। ইতিবাচক অনুভূতিগুলি ইতিবাচক উপভোগ তৈরি করে, নেতিবাচক অনুভূতিগুলি নেতিবাচক উপভোগ। পূজায় নূতন জামায় সাজিয়া ঠাকুর দেখিতে বাহির হইলে উপভোগের মাত্রা বাড়ে, আবার অসুস্থ হইয়া হাসপাতালে ভর্তি হইলে উপভোগ কমে। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি কাহারও অকালমৃত্যু ঘটে, তাহা সকল উপভোগের সমাপ্তি ঘটায়— অথবা, বৃহত্তম নেতিবাচক উপভোগ হইয়া দাঁড়ায়। যুক্তি বলিবে, কোন ঘটনা ঘটিবার সম্ভাবনা কতখানি, এবং ঘটিলে তাহার উপভোগের পরিমাণই বা কী, সেই হিসাব কষিয়াই সিদ্ধান্ত করা বিধেয়। অর্থাৎ, কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত হইয়া হাসপাতালে পড়িয়া থাকিবার সম্ভাবনা যদি যথেষ্ট হয়, তবে ঠাকুর দেখিবার উপভোগটি বাদ দেওয়াই বিধেয়, কারণ অসুস্থতার নেতিবাচক উপভোগের বোঝা অনেক বেশি ভারী।
মুশকিল হইল, মানুষ সুপারকম্পিউটার নহে। কোভিড-১৯’এর কথা শুনিতেছে, সংবাদপত্রে পড়িতেছে, হয়তো আশেপাশে কাহাকে অসুস্থ হইতেও দেখিতেছে— কিন্তু পূজায় রাস্তায় নামিলে নিজের কোভিডে আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা ঠিক কতখানি, এবং সেই সম্ভাবনার ফলে মোট প্রত্যাশিত নেতিবাচক উপভোগের পরিমাণই বা কী, মানুষের মগজ এই হিসাব কষিতে পারে না। সাধারণ বা অ-সাধারণ, কোনও মানুষের পক্ষেই এই আঁক কষিয়া ফেলা অসম্ভব। ফলে, বিপদটির সম্ভাবনা বুঝিতে মানুষ তাহার তীব্রতা আঁচ করিবার চেষ্টা করে। কোনও নিকটজনের কোভিড হইলে, অথবা অন্য কোনও ব্যাধির চিকিৎসায় বিপুল অর্থব্যয় বা দুর্ভোগের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থাকিলে নিজের কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা যতখানি তীব্র বোধ হয়, অন্য ক্ষেত্রে ততখানি হয় না। অন্য দিকে, যাঁহাদের জীবনে বিনোদনের অভাব— অর্থনৈতিক বা অন্য কারণে যাঁহারা ব্যক্তিগত বিনোদনের ব্যবস্থা করিয়া উঠিতে পারেন না— তাঁহাদের নিকট পূজার বিনোদনের উপভোগ তীব্র ও প্রত্যক্ষ। ফলে, তাঁহাদের মাথায় লাভ-ক্ষতির অঙ্কটি চলে ভুল হিসাবের ভিত্তিতে। প্রশ্ন হইল, ব্যক্তির ভুলের মাসুল সমাজকে কতখানি চুকাইতে হইবে? সেই ধাক্কা সামলাইবার জোর সমাজের আছে কি?