গ্রামে ঢোকার মুখেই বাঁকটা পেরিয়ে রাস্তার পাশের জলের কলে আটকে গেল চোখ। কল থেকে প্রচণ্ড গতিতে জল পড়েই যাচ্ছে। কলের মুখে কোনও ছিপি বা মুখ লাগানো নেই। প্রথমে হয়তো ছিল। এখন ভেঙে গিয়েছে বা চুরি গিয়েছে। গ্রামের মানুষ, পঞ্চায়েত কিংবা সরকারি দফতরের লোকজন কেউই সেটা লাগাননি কিংবা লাগানোর প্রয়োজনও বোধ করেননি। মোটরবাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরেই পাশের বাড়ি থেকে এক জন মহিলা বালতি নিয়ে এসে জল ভর্তি করে চলে যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এ ভাবে জল পড়ে যাচ্ছে। আপনারা তো নিজে থেকেই ছিপি কিনে লাগাতে পারেন বা পঞ্চায়েতে খবর দিতে পারেন। সেটা করেন না কেন?’’ মহিলার উত্তর, ‘‘আমরা কি একা জল খাই নাকি? আরও তো সবাই খায়, কাপড় কাচে, ওদের বলুন!’’
রাস্তা দিয়ে এক জন মাঝবয়সী ব্যক্তি হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করতে উত্তর এল, ‘‘মাঝে মধ্যে চাঁদা তুলে কলের ছিপি কেনা হয়। কিন্তু দু’এক দিন পরে ফের চুরি হয়ে যায়।’’ কথা না বাড়িয়ে কিছু দূর এগিয়ে আর একটি ট্যাপের সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম, কেউ এক জন কলের নীচে বালতি রেখে চলে গিয়েছেন। বালতি ভর্তি হয়ে উপচ পড়ছে জল। তাড়াতাড়ি কলের মুখটা বন্ধ করে অপেক্ষা করলাম বালতিওয়ালার জন্য। প্রায় মিনিট সাতেক পর ঘাড়ে গামছা ঝুলিয়ে বালতি নিতে এলেন এক জন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি এমন ভাব করলেন যেন আমি বেশ মজার একটা কথা বলেছি। সে দিন গ্রামের পথে প্রায় ন’টি জলের কল দেখেছিলাম। যার পাঁচটিতেই কোনও মুখ বা ছিপি ছিল না। তিনটিতে ছিপি থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ ছিল না। আর একটি বন্ধ ছিল কিন্তু প্যাঁচ ঠিক না থাকায় অল্প অল্প জল পড়ছিল।
এটা শুধু একটি গ্রামের বিচ্ছিন্ন কোনও দৃশ্য নয়, শহর, বাজার সর্বত্রই এই দৃশ্য আমাদের এমন চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জল পড়ে গেলেও আমাদের কিছু মনে হয় না। পুরসভার এমন অনেক কল আছে যা খোলা বা বন্ধের কোনও ব্যবস্থাই নেই। শুধু রাস্তার কলই নয়, বাড়ির ট্যাঙ্ক উপচেও প্রচুর জল অপচয় হয়। শৌচাগারে বালতি, জলের পাত্র বাথটব থেকে জল উপচে পড়তে থাকলেও আমাদের বিশেষ হেলদোল থাকে না। এমনকি পুরসভার সরবরাহ করা পানীয় জল দিয়েই অনেকে গাড়ি কিংবা কাপড় পরিষ্কার করেন।
এ দিকে আগামী দু’বছরের মধ্যেই ২১টি নগরীর পানীয় জলের জোগান শেষ হতে চলেছে বলে নীতি আয়োগের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে পানীয় জলের চাহিদা জোগানের থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। ২৪টি রাজ্যের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই উদ্বেগজনক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আগামী দিনগুলোতে পানীয় জলের সঙ্কট ভয়াবহ আকার নেবে। যার প্রভাব পড়বে ১০০ মিলিয়ন নাগরিকের উপর। তীব্র পানীয় জলের সঙ্কট বয়ে নিয়ে আসবে দেশবাসীর খাদ্য নিরাপত্তার চরম অভাব। কারণ কৃষি নির্ভরশীল দেশে ৮০ শতাংশ জল ব্যবহৃত হয় কৃষিতে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাডু প্রভৃতি রাজ্যের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এই রাজ্যগুলি সমগ্র দেশে কৃষিজ উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ফলে, ওই রাজ্যগুলোও যে বিপুল জলকষ্টের মধ্যে পড়তে চলেছেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্ব জুড়েই জলের সঙ্কট তীব্র হচ্ছে। এর প্রধান কারণ জলের অপচয়, ভোগবাদী সমাজে জলের অপরিমিত ব্যবহার। জলের এই অপচয় রুখতে একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। যেমন বাড়িতে জলের মিটার চালু করা, জলকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, জলের ট্যাপের প্রতি খেয়াল রাখা। ট্যাপ ভেঙে গেলে বা চুরি হলে পুনরায় লাগিয়ে দেওয়া। মুখ ধোয়ার সময় ট্যাপের মুখ বন্ধ রাখা, কাপড় বা থালা-বাসন পরিষ্কার করার সময় যাতে জল অপচয় না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া, পুকুর বা নদীর জল যাতে দূষিত না হয় সে দিকে নজর রাখা, স্নানের সময় প্রয়োজনাতিরিক্ত জল ব্যবহার না করা, যখন তখন ইচ্ছে হলেই জল ফেলে দেওয়া থেকে বিরত থাকা— এ ভাবে কিছু সাধারণ নিয়ম বা সতর্কতা আমরা যদি মেনে চলি তা হলে জলের অপচয় কিছুটা হলেও রোধ করতে পারব।
এ ছাড়াও, গোটা বিশ্ব জুড়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ঠান্ডা পানীয় ও কারখানার প্রয়োজনে যে পরিমানে ভূ-গর্ভস্থ জল তোলে এবং অপচয় করে তার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকা ও তাকে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে সরকারি ভাবে কড়া নজরদারি জরুরি। না হলে একদিন হয়তো আমাদের এই সাধের পৃথিবী চিরতরে হারিয়ে যাবে। অনেক দিন আগে কে যেন মজা করে বলছিল— অপেক্ষা কর, সুসময় আসছে। সে দিন ঘর, বাড়ি, গাড়ি জলের দামেই পাওয়া যাবে। সে দিন মজাটা বুঝিনি। এখন বুঝতে পারছি। এটাও বুঝতে পারছি যে, শেষের সে দিন আসতে বোধহয় খুব বেশি দেরি নেই। যদি আমরা সকলেই জল অপচয় সম্পর্কে সচেতন না হই তা হলে বিপদ আরও বাড়বে। বেড়েই চলবে। তাই সব কিছুর আগে জরুরি জলের প্রয়োজনীয়তা বোঝা, জলের ব্যবহার ও অপচয় সম্পর্কে গণসচেতনতা।