সম্পাদকীয় ২

স্বাগত অশান্তি

ভারতের সমাজ এখনও যৌন হেনস্থা ও তাহার প্রতিকারের দাবিকে ‘কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি’ বলিয়া দেখিতেই অভ্যস্ত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৮ ০৯:৩৮
Share:

উৎসবের দীপ জ্বলিবার পূর্বেই নিভিল। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার স্থগিত হইল এই বৎসর। ইহার কি প্রয়োজন ছিল? সংক্ষিপ্ত কিন্তু সুনিশ্চিত উত্তর, হ্যাঁ। মহিলাদের অমর্যাদা ও বৈষম্যের প্রতিবাদ গোটা বিশ্বকে আন্দোলিত করিতেছে। তাহারই তরঙ্গ আঘাত করিয়াছে দুই শতাব্দী প্রাচীন সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে। ওই সংগঠনের ঘনিষ্ঠ, প্রভাবশালী এক ব্যক্তি মহিলাদের যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত হইয়াছেন। তাঁহার কুকীর্তিকে আড়াল করিবার অভিযোগও উঠিয়াছে অ্যাকাডেমির প্রতি। অ্যাকাডেমির অভ্যন্তরীণ সংস্কারের চেষ্টা প্রতিহত হইয়াছে, প্রায় অর্ধেক সদস্য পদত্যাগ করিয়াছেন। নোবেল ফাউন্ডেশন তাহাকে পরামর্শ দিয়াছে, মানুষের আস্থা ফিরিয়া পাইতে স্বচ্ছতা আনিতে হইবে তাহার কাজে। সুইডিশ অ্যাকাডেমির এই বিড়ম্বনা একটি দৃষ্টান্তমাত্র। মহিলাদের যৌন হেনস্থা-বিরোধী ‘আমিও’ আন্দোলনটি যত শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে, তত উন্মোচিত হইয়াছে নারীবিদ্বেষ, নারীবঞ্চনার ব্যাপকতা। বৈষম্যের মোকাবিলা করিতে গিয়া বিবিধ প্রতিষ্ঠান বালির দুর্গের মতো ধসিয়া পড়িতেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা বন্ধ হইয়াছে। পশ্চিম দুনিয়ার কিছু দলের পদাধিকারী ও মন্ত্রীরা পদত্যাগ করিয়াছেন। মার্কিন প্রেসি়ডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দফতরও যৌন হেনস্থার মোকাবিলায় নাজেহাল।

Advertisement

ভারতের সমাজ এখনও যৌন হেনস্থা ও তাহার প্রতিকারের দাবিকে ‘কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি’ বলিয়া দেখিতেই অভ্যস্ত। বিশেষত একটি যুক্তি অত্যন্ত জোরের সহিত পেশ করা হয় যে, যৌনতা লইয়া জনজীবনে আলোচনা একান্তই পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। প্রাচ্যে, বিশেষত ভারতের মহান ঐতিহ্যে, যৌনতা ও তৎসংক্রান্ত যাবতীয় আলোচনা রাজনীতি ও কর্মসংস্কৃতি হইতে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। পাশ্চাত্যে যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠিলে অত্যুচ্চ পদাধিকারীকেও জনজীবনে ধিক্কৃত হইয়া বিদায় লইতে হয়। কিন্তু ভারতে অভিযোগ প্রমাণিত হইবার পরেও অভিযুক্তদের সামাজিক প্রতিষ্ঠায় পরিবর্তন হয় না। ১৯৮৮ সালে পঞ্জাবের পুলিশের তৎকালীন ডিজিপি কেপিএস গিলের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করিয়াছিলেন সরকারি আধিকারিক রুপান দেওল বাজাজ। পরের বৎসরই গিলকে ‘পদ্মশ্রী’ দেয় রাষ্ট্র। পরে আদালতে গিল দোষী সব্যস্ত হইলেও পদ্মশ্রী প্রত্যাহৃত হয় নাই।

এই ধারা সমানে চলিয়াছে। ভারতের বিভিন্ন দলের আটচল্লিশ জন বিধায়ক এবং তিন জন সাংসদের বিরুদ্ধে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলা চলিতেছে ধর্ষণ-সহ নানা নির্যাতনের অভিযোগে। এমন ব্যক্তিদের প্রার্থী করিলে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হইতে পারে, সেই আশঙ্কা শীর্ষ নেতাদের নাই। বরং ধর্ষণে অভিযুক্তের কত দূর দলীয় সমর্থন মিলিতে পারে, তাহার দৃষ্টান্ত মিলিয়াছে উন্নাও এবং কাঠুয়াতে। অতএব দেশে যদি বৈষম্যহীন, নির্যাতনহীন, স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানের দাবি ওঠে, তাহাতে পরিবার হইতে প্রশাসন, সামরিক বাহিনী হইতে বিচারব্যবস্থা, সকলের ভিত্তি টলিবে। তবে কি স্থিতাবস্থা বজায় রাখিতে নির্যাতন সহিতে হইবে? দার্শনিক মিশেল ফুকো বলিয়াছেন, শান্তিও এক প্রকার যুদ্ধ। পুরুষতন্ত্র বৈষম্যের শর্তে শান্তি বজায় রাখিতে চায়। মেয়েরা না মানিলেই গোল বাধিবে। ঐতিহ্য ধূলিসাৎ হইবে, ফুৎকারে মিলাইবে পরম্পরা। সেই অশান্তি স্বাগত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement