ঠিক তেরো বছর আগে লোকপালের দাবিতে অনশনরত অণ্ণা হজারের পাশে বসে অপেক্ষাকৃত তরুণ অরবিন্দ কেজরীওয়াল সতর্কীকরণের ঢঙে বলেছিলেন, “এমনটা যেন না হয়, আমাদের মধ্যে কেউ ক্ষমতায় চলে আসার পর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তা হলে লড়াইয়ের মূল যে আদর্শ, তার থেকেই বিচ্যুত হতে হবে।”
সম্ভবত নিয়তি মুচকি হেসেছিলেন তখন! আজ এক কঠিন সময়ে কেজরীওয়ালের সেই উদ্ধৃতি রিল হয়ে সমাজমাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে, যখন আম আদমি পার্টির রাজনৈতিক উত্থানের বীজমন্ত্রটিতেই অবিশ্বাস আর সন্দেহের অনুপ্রবেশ। আগুনের মধ্যে হাঁটছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। আমেরিকা, জার্মানি, এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জেও তাঁর এই গ্রেফতারের ঘটনা স্পন্দন তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তথ্যসম্বলিত পাথুরে প্রমাণ দিয়ে, তাঁকেই এই আগুন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। লোকসভা নির্বাচনের পায়ে-পায়েই আসছে দিল্লির ভোট। আগামী বছরের গোড়ায় সেই নির্বাচন পর্যন্ত তাঁর হাতে সময়।
বানিয়া পরিবারে বড় হওয়া হরিয়ানার এই কিশোরটি প্রথম তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সর্বভারতীয় আইআইটি-জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার মেধা-তালিকায় উপরের দিকের স্থান অধিকার করে। আইআইটি খড়্গপুরে মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং পড়া সেই যুবকের পিছন ফিরে দেখতে হয়নি আর। যাতে হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। জামশেদপুরে টাটা স্টিলের উচ্চপদ বা পরে আইআরএস দিয়ে ইনকাম ট্যাক্স কমিশনার, পেশাদার জীবনের সমান্তরাল ভাবে সমাজকর্মী হিসাবেই নিরন্তর সক্রিয়তা থেকে গিয়েছে তাঁর। তা সে মাদার টেরেসার মিশনারিজ় অব চ্যারিটি বা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হোক বা গণবণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের অভিযোগকে তুলে ধরতে ‘পরিবর্তন’ নামের সংস্থা খুলে, আন্দোলনকারী হিসাবে।
২০১১ সালে যখন রাজনীতির ময়দানে পা রাখেন কেজরী, তিনি ছিলেন সে জগতে নেহাতই বহিরাগত। এক বছরের সমাজ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছাড়া তাঁর ঝুলিতে বিশেষ কিছু ছিল না। তার পর ধূমকেতুর মতো উত্থান রাজনৈতিক নেতা হিসাবে, নতুন দল গড়ে বার বার দিল্লির বিধানসভায় বিপুল জয় কুড়িয়ে নিয়ে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রাজধানীতে তাঁর এবং নরেন্দ্র মোদীর উত্থান কিন্তু সমসমায়িক। ২০১৩ সালে তিনি প্রথম বার মুখ্যমন্ত্রী হন স্বল্পমেয়াদে। তার পর ২০১৪ সালে বারাণসী নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রকাশ্যে মোদীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পর, ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদীর সামনে থেকে দিল্লির ৭০টি বিধানসভা আসনের ৬৭টি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন কেজরীওয়াল। সম্প্রতি কেজরী এ কথাও বলেন, “বিজেপির সবচেয়ে বড় শত্রু এই মুহূর্তে আপ, যে ২০২৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপিমুক্ত ভারত গঠন করার ক্ষমতা রাখে।”
কথাটা নেহাতই শূন্যগর্ভ ছিল না। কেজরীর উত্থান গোড়া থেকেই ভাবিয়েছে মোদী-অমিত শাহকে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কামান দেগে কেজরীওয়াল দিল্লি দখল করে রেখে দিয়েছেন প্রায় এক দশক। শুধু তা-ই নয়, গোটা দেশ জুড়ে প্রবল মোদী হাওয়ার মধ্যে নিজের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক প্রত্যয় তৈরি করেছেন। রাজধানীর সরকারি হাসপাতাল এবং বিদ্যালয়গুলির হাল বদলে দিয়েছেন ম্যাজিকের মতো। এর পর পঞ্জাব দখল করে, গুজরাত এবং অন্যান্য রাজ্য নিয়েও সক্রিয়তা শুরু করেছেন। প্রতিপদে খোঁচা গিয়ে কথা বলেছেন মোদীকে, তা প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাগত স্বল্পতা নিয়েই হোক, বা মোদী সরকারের দুর্নীতি।
বিজেপির পাল্টা কৌশল, কেজরীর যেখানে শক্তি, সেখানেই সুচ ফোটানোর। কারণ কেশ স্পর্শ করলে স্যামসনের যেমন শক্তি শেষ, তেমনই দুর্নীতির আঁশটে গন্ধ আপ-এ ধরলে, শেষ কেজরীওয়ালের ভাবমূর্তি। প্রধানমন্ত্রীর নিজের ‘ফকির’ পরিচয় চিহ্নের রাজনীতিতে কেজরীওয়াল এক অবিসংবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। আর এখন এমন একটা সময়, যখন নির্বাচনী বন্ডকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার ভাষ্য তৈরি হচ্ছে।
আপ এবং বিজেপির মধ্যে জায়গা দখলের লড়াই শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করার পর থেকে। যেখানে বলা হয়েছিল, জমি সংক্রান্ত বিষয়, পুলিশি প্রশাসন, পাবলিক অর্ডারের মতো বিষয় থাকবে দিল্লির লেফটেন্যান্ট গর্ভনরের অধীনে। এর পর চলতে থাকে দীর্ঘ আইনি যুদ্ধ। গত বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি সরকারের পক্ষে রায় দিলেও তৎক্ষণাৎ কেন্দ্রীয় সরকার অধ্যাদেশ এনে আইন করে এলজি-র হাতেই ফের ক্ষমতা অর্পণ করে।
অরবিন্দ কেজরীওয়াল শুধু আপ-এর প্রতিষ্ঠাতা নন, দলের প্রধান মুখও। অতীতে বহু ঝড়ঝাপটা সামলে আপ-কে জাতীয় দলে পরিণত করেছেন। প্রকাশ্যে বার বার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন মোদীকে। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, না কি এক জন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, শেষ পর্যন্ত মানুষে তাঁকে কী ভাবে মনে রাখবেন, তা এই লোকসভায় না হলেও আগামী বছরের গোড়ায় দিল্লি নির্বাচনে স্পষ্ট হবে। কেজরীওয়ালকে গ্রেফতারের ঘটনা হয় বিজেপিকে সুবিধা করে দেবে বৃহত্তর রাজনীতিতে আপ-কে নির্মূল করতে, অথবা আগুনের ভিতর থেকে উঠে আসবেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। আরও শক্ত হবে তাঁর হাত।
এই সন্ধিমুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ তথা বিরোধী রাজনীতির এই পর্ব।