ছবি: সংগৃহীত।
সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে এবং তা আগামী এক মাস ধরে চলবে। সাধারণত, এই পর্বটা তর্কবিতর্ক, আলোচনার মাধ্যমে বাজেট প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করার দিকে এগোনোর জন্য খুবই ফলপ্রসূ। তবে সরকারপক্ষ, বিরোধীপক্ষ, সর্বোপরি স্পিকার যদি এই অধিবেশনটি সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করেন, সে লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয়।
এই বছরটা হয়তো একটু অন্য রকমের। নিঃসন্দেহে, এর প্রাথমিক কারণ, সম্প্রতি দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার পরবর্তী প্রভাব। ওই হত্যাকাণ্ডের পর সরকারকে বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। যদিও অধিবেশনের দু’দিন কেটে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, বিজেপির দালালদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে সংসদের কাজকর্ম ঠিকঠাক ভাবে সম্পন্ন না হয়। অন্য কারণটা হল, প্রায় নেপথ্যে থেকেই রাজ্যসভার বিধিনিয়ম আমূল পাল্টানোর একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। এটা সংসদ এবং আমাদের গণতন্ত্রের উপর বিষম প্রভাব ফেলবে।
কাহিনিটা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। নিয়মকানুন খতিয়ে দেখতে এবং তাতে সম্ভাব্য সংশোধনের জন্য সেই বছর রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এম বেঙ্কাইয়া নায়ডু দু’জন অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। ওই দু’সদস্যের কমিটির সুপারিশগুলো রাজ্যসভার জেনারেল পারপাস কমিটি (জিপিসি)-র কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: মানুষ থাকব, না অমানুষ হব
সম্প্রতি, এই উদ্দেশ্যে জিপিসি-র একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল। জিপিসি-তে সাধারণত রাজ্যসভার সব রাজনৈতিক দলের নেতা এবং গোষ্ঠীর সদস্য থাকেন। তবে এই নির্দিষ্ট জিপিসি বৈঠকে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি), আম আদমি পার্টি এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কোনও প্রতিনিধি ছিলেন না। তবে সৌভাগ্যবশত, চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন ভবিষ্যতে জিপিসি-র বৈঠকে ওই দলগুলি প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে।
সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম দল তৃণমূল কংগ্রেসের এক জন সদস্য হিসাবে আমার বিশ্বাস, হুড়োহুড়ি করে রাজ্যসভার নিয়মকানুন পরিবর্তন করা যায় না। এই নিয়মগুলি আমাদের সংবিধান প্রণেতারা অনেক চিন্তা-ভাবনার পর তৈরি করেছিলেন। তাতে সংশোধনেও যথেষ্ট বিশ্লেষণ এবং আলোচনার প্রয়োজন। দুই প্রাক্তন আমলার কমিটিও বহু বার পরামর্শ নিয়েছে। আশা করব, জিপিসি-ও এ নিয়ে বহু বার বৈঠক করবে। জিপিসি-র আলোচনা শেষ হলে, তার রিপোর্ট রাজ্যসভার কমিটি অব রুলস-এ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কমিটি অব রুলস-এর আশি শতাংশ সদস্যই ক্ষমতাসীন দলের। এর পর তাঁরা এ বিষয়ে মতামত দেন। এর পর কমিটি অব রুলস-এর চূড়ান্ত রিপোর্টটি সংসদে ভোটাভুটির জন্য পেশ করা হয়।
এটাই প্রক্রিয়া। তা এই সংশোধন কেন? সরকারের মতে, সভাকক্ষের কাজকর্ম আরও নিয়ন্ত্রিত ও মসৃণ ভাবে কার্যকর করার জন্য, তা আরও নিয়মিত ও বিঘ্নহীন ভাবে করার জন্যই এই সংশোধন। কাগজেকলমে, এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে বাস্তবে, এটা কি রাজ্যসভায় বিরোধীদের চুপ করিয়ে রাখার একটা প্রচেষ্টা? এটা কি বিরোধীদের কড়া প্রশ্ন নিষ্ক্রিয় করার একটা প্রচেষ্টা, যাতে সংসদে সরকারকে জবাবদিহি না করতে হয়?
আরও পড়ুন: বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কিসে রে...
রাজ্যসভার সদস্য প্রয়াত অরুণ জেটলি সভায় বাধাদানের অধিকারের স্বপক্ষে ছিলেন। তিনি একে বলেছিলেন, ‘‘সংসদীয় রীতিনীতিতে বিরোধীদের হাতে যে সব সুবিধা রয়েছে, তার মাধ্যমে সরকারের স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য একটি বৈধ কৌশল।’’ যদি ‘‘সংসদীয় দায়বদ্ধতা এড়ানোর জন্য তর্কবিতর্কের ঢাল দিয়ে তা চাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়।’’ ২০১২-র অগস্টে এমনটা বলেছিলেন তিনি। এর পরের মাসে তাঁর সহকর্মী ও সংসদের আরও এক সদস্য প্রয়াত সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ‘‘সংসদের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হাতিয়ারও গণতন্ত্রের অন্য অনেক হাতিয়ারের একটি।’’
জেটলি এবং স্বরাজ যেটা বলতে চেয়েছেন তা হল, সংসদে আলোচনা এবং তর্কবিতর্ক কেবলমাত্র সময়োচিত একটি কাজ নয়। তা ওই কাজের গুণমানের উপরেও নির্ভরশীল। সংসদের অধিবেশনের পরিমাপ মিনিট বা ঘণ্টা মেপে করা যায় না। তা ওই সময়কালে বিষয়বস্তুর গুণমানের উপর নির্ভর করে।
প্রথমেই জিজ্ঞাসা করি, বিরোধীদের উত্থাপন করা কতগুলি ইস্যু রয়েছে, যা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটির অ্যালায়েন্স সরকার আলোচনা করার সুযোগ দিয়েছে? ২০১২-তে বিজেপি সংসদের একটি গোটা অধিবেশনই নষ্ট করেছে কয়লা-কেলেঙ্কারি নিয়ে আলোচনার দাবি তুলে। এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দল সে ধরনের সংসদীয় প্রতিবাদকে অসম্ভব করে তুলতে চায়। তারা সে সুযোগ থেকে বিরোধীদের বঞ্চিত রাখতে চায়। এবং সরকারকে জবাবদিহি করা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়, যদিও বিরোধী থাকাকালীন তারা সেই সুযোগটাই নিয়ে এসেছে।
আরও একটা উদাহরণ দিই। অধিবেশনের শুরুতেই সাধারণত ‘সংসদীয় কৌশল’-এর রূপ উদ্ঘাটন করে ফেলে রাজনৈতিক দলগুলি। অন্য দিকে, ‘যুদ্ধকৌশল’ তৈরি করতে হয় সংসদের ভিতরে, রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা। সদস্যদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার রয়েছে, তা হল রাজ্যসভার রুল ২৬৭। এর সাহায্যে অধিবেশনের দিনের সমস্ত কাজ স্থগিত রেখে আলোচনার জন্য বিরোধী সাংসদেরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর মূল অংশগুলি তুলে ধরেন। আমি রাজ্যসভায় এসেছিলাম ২০১১ সালে। সে সময়কার এক জন সদস্য এখন বেশ হাইপ্রোফাইল মন্ত্রী। তিনি বেশ কার্যকর ভাবে রুল ২৬৭ ব্যবহার করতেন। এক বছরের মধ্যেই আমরা রসিকতা করে তাঁকে ‘২৬৭-এর রাজা’ বলে ডাকতে শুরু করি।
এই মুহূর্তে রুল ২৬৭-এর অবস্থানটা কী? এটা কার্যত বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। রুল ২৬৭-এর আওতায় যে নোটিস পড়েছিল, সেটা হয়েছিল ২০১৬-র নভেম্বরে। তখন থেকে রুল ২৬৭-এর আওতায় নোটিস দেওয়ার দাবি তুলে আসছেন সদস্যরা। কিন্তু, সব সময়ের মতোই সেই দাবি খারিজ হয়ে গিয়েছে।
সংসদের ওয়েলে ছুটে যাওয়াটাও একটা বেশ কার্যকরী কৌশল। সংসদের কাজে বাধাদানের জন্য এটি বেশ কার্যকরী ভাবে ব্যবহার করেছেন সদস্যরা। বিশেষত, যখন তাঁদের অন্য হাতিয়ারের অধিকার ব্যবহারে বাধা দেওয়া হয়েছে। সভাকক্ষের ওয়েলে নেমে যাওয়া এবং রুল ২৬৭ ব্যবহার হল রাজ্যসভার বেশ চিরাচরিত হাতিয়ার। সংসদীয় ইতিহাসে সমস্ত রাজনৈতিক দলই তা ব্যবহার করেছে। এই হাতিয়ারগুলিকে ভোঁতা করে দেওয়ার যে কোনও প্রচেষ্টাই শুধুমাত্র চিরাচরিত সংসদীয় প্রথার বিরোধীই নয়, তা অগণতান্ত্রিকও বটে।
আবার, এটিও প্রয়োজনীয় নয় যে সংসদের দুই কক্ষেই একই ভাবে কাজ চলবে। সংসদের দুই কক্ষের জন্য সংবিধানে দু’রকমের কর্মপদ্ধতির নিদান রয়েছে। যাতে নিয়মনীতিগুলি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্টকে বজায় রাখতে পারে। রাজ্যসভার এই অতুলনীয় বৈশিষ্টকে সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিতে হবে জিপিসি-কে। রাজ্যসভার প্রথম চেয়ারম্যান হিসাবে বলতে উঠে ডক্টর এস রাধাকৃষ্ণন বলেন, ‘‘এমন কিছু কার্যাবলী রয়েছে, যা এখানে ফলপ্রসূ ভাবে করা যায়। সংসদ কেবলমাত্র আইনসভা নয়, একটি আলোচনাসভাও বটে।’’
রাজ্যসভার কাজকর্ম মসৃণ ভাবে যাতে চলে, তা দেখা ছাড়াও সংসদের বাক্স্বাধীনতাও যাতে রক্ষিত হয়, তা দেখার গুরুদায়িত্ব এখন জিপিসি-র উপরেই বর্তায়। সংবিধান প্রদত্ত সাংসদদের বাক্স্বাধীনতা ও অন্য অধিকার হ্রাস করার চেষ্টা করার জন্য কোনও বিধিনিয়মে পরিবর্তন অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। জিপিসি কখনই নিয়ম পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিরোধীদের হাত-পা বেঁধে বা মুখবন্ধ করে রাখতে পারে না।
লেখক রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা।