সম্পাদকীয় ১

গণতন্ত্রের শর্ত

এ-হেন মামলা স্বাভাবিক বলিয়াই গণ্য হইতে পারে, গণপ্রহার যেমন ক্রমে স্বাভাবিক হইয়া উঠিয়াছে। তখন পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এমন মামলা প্রত্যাহার করিয়া লইবে না, সেই আশঙ্কা প্রবল। এবং রাষ্ট্রীয় শাসনের ভয়ে মানুষ প্রতিবাদ করা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিবে, তেমন আশঙ্কা প্রবলতর। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০২
Share:

দেশের কর্ণধারদেরও অনুভব করিতে হইবে, কোন তাড়না হইতে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এমন চিঠি লিখিতে পারেন। ফাইল চিত্র।

মা কী ছিলেন আর কী হইয়াছেন, বিহারের আইনজীবী সুশীল কুমার ওঝার নিকট বোধ করি এই প্রশ্নের উত্তর আছে— তিনি বলিবেন, (দেশ)মাতৃকা এখন প্রধানমন্ত্রী রূপে সংস্থিতা। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে চিঠি লেখাও সেই দেশমাতৃকার অবমাননা, অর্থাৎ দেশদ্রোহ। অতএব আদুর গোপালকৃষ্ণন, রামচন্দ্র গুহ, অপর্ণা সেন প্রমুখের বিরুদ্ধে তিনি দেশদ্রোহের মামলা ঠুকিয়াছিলেন। সুশীল কুমার ওঝা ব্যক্তিবিশেষ, ফলে তাঁহার কাণ্ডজ্ঞানের অভাব জাতীয় দুশ্চিন্তার কারণ নহে। কিন্তু, ইহা কুনাট্যের সূচনাবিন্দুমাত্র। যে আদালতে তিনি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করিয়াছিলেন, সেই আদালত তাঁহার আবেদনপত্রটি বাতিল কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে নাই। পুলিশকে অভিযোগ নথিভুক্ত করিবার আদেশ দিয়াছিল। পুলিশও আদালতের নির্দেশ শিরোধার্য করিয়া এই বিদ্বজ্জনদের নামে ফাইল খুলিয়াছিল। দেশজোড়া হইচইয়ের পরে বিহার পুলিশের কর্তা জানাইয়াছেন, অভিযোগটি বাতিল হইয়াছে, বরং বাদীর নামেই অভিযোগ দায়ের করা হইবে। অভিযোগটি যে হাস্যকর— অথবা, অতি বিপজ্জনক— তাহা বুঝিতে বিহার পুলিশকে কেন জনমত সংগঠিত হওয়া অবধি অপেক্ষা করিতে হইল, সেই প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ। আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কথাটি যে, সবই সহিয়া যায়। আজ চিঠি লেখার কারণে দেশদ্রোহের মামলা হইলে সাধারণ মানুষের যে প্রতিক্রিয়া হয়, পরশুর পরের দিন তাহা না-ই হইতে পারে। এ-হেন মামলা স্বাভাবিক বলিয়াই গণ্য হইতে পারে, গণপ্রহার যেমন ক্রমে স্বাভাবিক হইয়া উঠিয়াছে। তখন পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এমন মামলা প্রত্যাহার করিয়া লইবে না, সেই আশঙ্কা প্রবল। এবং রাষ্ট্রীয় শাসনের ভয়ে মানুষ প্রতিবাদ করা সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিবে, তেমন আশঙ্কা প্রবলতর।

Advertisement

গণতন্ত্রের পক্ষে তেমন পরিস্থিতি প্রাণঘাতী। কারণ, শাসকের সহিত শাসিতের সংলাপের পরিসরটির নামই গণতন্ত্র— যেখানে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কেহ রাজা নহেন, দেশের প্রতীকও নহেন, সাধারণ মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিমাত্র। তাঁহার সহিত মানুষের সম্পর্ক একমুখী নহে, আদানপ্রদানের। রাষ্ট্রের চলনে আপত্তি থাকিলে নাগরিক দেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে পত্র লিখিবেন, অথবা গণমাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করিবেন, ইহা গণতন্ত্রের অতি পরিচিত এবং স্বীকৃত পন্থা। ইহাতে রাষ্ট্রদ্রোহ নাই, বরং রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন রহিয়াছে। রামচন্দ্র গুহরা যে চিঠিটি লিখিয়াছিলেন, তাহার কথাই ধরা যাউক। তাঁহারা গণপ্রহারের ঘটনার প্রাবল্যে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছিলেন। সেই উদ্বেগ তাঁহাদের ব্যক্তিবিশেষের জন্য নহে— গোটা দেশের জন্য, দেশের নাগরিকদের জন্য। ভারত যাহাতে সাধারণ ভারতবাসীর পক্ষে নিরাপদতর, স্বাধীনতর হইতে পারে, তাহা ব্যতীত আর কোনও আর্জি পত্রটির মূল সুরে ছিল না। এই নিরাপত্তার কামনা দেশের জন্য না হইলে আর কাহার জন্য? এবং দেশের প্রতি ভালবাসা, দায়বদ্ধতা না থাকিলে এমন কামনা আসিবে কোথা হইতে?

এই কথাগুলি কোনও ব্যক্তিবিশেষ না-ই বুঝিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তাহা বুঝিতে হইবে। দেশের কর্ণধারদেরও অনুভব করিতে হইবে, কোন তাড়না হইতে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এমন চিঠি লিখিতে পারেন। সেই উদ্বেগকে সম্মান করাই বিধেয়। এই ঘটনাক্রমে প্রধানমন্ত্রীর কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও মিলে নাই। তিনি জানাইয়া দিতে পারেন, চিঠিটিতে তাঁহার কোনও সম্মানহানি হয় নাই, রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্রোহের তো প্রশ্নই নাই, বরং এই চিঠিই বলিয়া দেয় যে ভারতীয় গণতন্ত্র এখনও বাঁচিয়া আছে। এবং,সহনাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিকার তিনি করিবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেই স্থির করিতে হইবে, তিনি কোন ভারত চাহেন— সুশীল কুমার ওঝার ভারত, না কি রামচন্দ্র গুহ, আদুর গোপালকৃষ্ণনদের ভারত?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement