শুনছে কে? সৌদি আরব দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ। দিল্লি, সেপ্টেম্বর ২০১৫। ছবি: এএফপি
আর কত দিন কূটনৈতিক রক্ষাকবচের এই লীলা দেখতে হবে আমাদের? গত ১০ সেপ্টেম্বর গুড়গাঁওয়ের এক সৌদি নাগরিকের বাড়ি থেকে উদ্ধার হন দু’জন নেপালি গৃহপরিচারিকা। শোনা গেছে, এক জনের স্বামী দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত, অন্য জন এ বছরের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে সব-হারানো এক মা। এ দেশে তাঁদের কোনও এক মহিলা নিয়ে এসেছিলেন ভাল কাজ দেবেন বলে। এক প্রতারক রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির হাতে পড়েন তাঁরা। বলা হয়, তাঁরা মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পাবেন, সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার কাজ। এর পরে তাঁদের উপর যে অত্যাচারের কাহিনি শোনা গেছে, তার নৃশংসতা স্তম্ভিত করে দেয়। প্রথমে জেড্ডা, সারা দিন কাজের পর গৃহস্বামীর বন্ধুদের বিকৃত, যৌথ যৌনতার তৃপ্তি। নিয়মিত গণধর্ষণ। গৃহস্বামীকে বলেও লাভ হয়নি। আবার ভারতে ফেরত। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রথমে এক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, পরে চার জন চিকিৎসকের একটি মেডিকেল বোর্ড বলে, এঁরা নিয়মিত ধর্ষণ ও বিকৃত যন্ত্রণাদায়ক যৌন নিগ্রহের শিকার, সারা গায়ে ক্ষত, পায়ু আর যোনিদ্বার ছিন্নভিন্ন, সংক্রমণে পূর্ণ। সৌদি আরব বলে যে, কূটনীতিকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা— সৌদি সরকারের অনুমতি না নিয়ে তাঁর বাড়ি ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে গুড়গাঁও পুলিশ আন্তর্জাতিক আইন ভেঙেছে। ভারত কূটনৈতিকের রক্ষাকবচের জেনিভা সনদ অমান্য করে অন্যায় করেছে। তাই কি?
১৯৬১ সালের জেনিভা সনদ বলে কোনও দেশের কূটনীতিক যাতে স্বাধীন ভাবে, কোনও চাপ ছাড়া কাজ করতে পারেন, তার জন্য তাঁরা কূটনৈতিক রক্ষাকবচ বা ইমিউনিটি পান, তাঁদের বাড়িঘরে, বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট সরকারের অনুমতি ছাড়া তল্লাশি চালানো যায় না। কিন্তু তাঁদের কারও বিরুদ্ধে যখন একটি বিদেশি মেয়েকে নিয়োগ করে, আর একটি দেশের মাটিতে নিয়মিত শারীরিক আর যৌননিগ্রহ করা, খেতে না দেওয়া, চুক্তিমাফিক মজুরি না দেওয়া— এ সবের অভিযোগ ওঠে, তখনও সেই রক্ষাকবচ কাজ করবে? এই কাজগুলো কি কোনও কূটনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? ভারত সরকার সৌদি সরকারকে অনুরোধ জানাল যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যখন যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, তখন তার কূটনৈতিক রক্ষাকবচ প্রত্যাহার করে নিতে। সেই অনুরোধ রাখা তো দূরস্থান, ‘সাজানো ঘটনা’র দাবি করল সৌদি প্রশাসন। বলল, মেয়ে দু’টি টাকাকড়ি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় মিথ্যে বদনাম দিয়েছে। ভারত পড়ল মহা ফাঁপরে। এক দিকে প্রতিবেশী নেপালের মেয়েদের কর্মী হিসেবে অধিকার, মেয়ে হিসেবে অধিকার আর মানুষ হিসেবে অধিকার লঙ্ঘিত, অন্য দিকে সৌদির তেল আর বিনিয়োগের চাপ। এর সঙ্গে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী আই এস-এর সঙ্গে লড়াইতে সৌদি আরবকে পাশে পাওয়ার হিসেব তো আছেই। শেষ পর্যন্ত যে অভিযুক্ত সৌদি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ব্যক্তি ঘোষণা করতে হল না, সে নিজেই ঘটনার দিন দশেক পরে দেশ ছেড়ে চলে গেল, তাতে ভারত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বলা যায়। কাজের নামে প্রতারণা আর মানুষ পাচারের পান্ডা আনোয়ার ধরা পড়েনি।
কূটনৈতিক রক্ষাকবচকে অপব্যবহারের নিয়মিত নানান নজির রয়েছে। ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড ফিলিপিন্সের কূটনীতিককে ধর্ষণ আর ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করার পরেও ফিলিপিন্স তার রক্ষাকবচ প্রত্যাহার না করায় তাকে ছেড়ে দিতে হয়। কূটনীতিকদের বিমানবন্দরে তল্লাশি হয় না, এই সুযোগের অপব্যবহার করে ড্রাগ থেকে বেআইনি নানা জিনিস পাচারের নিয়মিত অভিযোগ আছে। একটি সমীক্ষা বলেছে, যে সব দেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় উপরের দিকে, মানে খুল্লম-খুল্লা দুর্নীতি, সে সব দেশের দূতাবাস কর্মীদের এ-সব অপরাধে ধরা পড়ার বহু সাক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঘটে বোধহয় গৃহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, চুক্তিমাফিক মজুরি না দেওয়া, চুক্তির থেকে অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করানো, ছুটি না দেওয়া, তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে, বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে বাস্তবিক দাসত্বে আটকে রাখার ঘটনা। গৃহপরিচারিকাকে ন্যূনতম বেতন না দেওয়া, সারা দিন খাটানো, দেশে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, পাসপোর্ট আটকে রাখার অভিযোগে দেবযানী খোবরাগাড়েকে মার্কিন প্রশাসন তল্লাশি করলে আমরা রেগে যাই, গৃহপরিচারিকা সঙ্গীতা রিচার্ডের অভিযোগকে আমরাও বলি ‘সাজানো’, ‘মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা’! সৌদি কূটনীতিকের মতো এত বড় মাত্রায় না হলেও, যৌন নিগ্রহের অভিযোগও অনেক সময়েই যুক্ত হয়। দেশে ফিরে যাবার পর বড়জোর তাদের কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের আদৌ বিচার হয় কি?
সারা পৃথিবীতেই এখন নানা কারণে ঘরের কাজের জন্য প্রশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত নানা ধরনের মানুষের চাহিদা বাড়ছে, এঁদের সিংহভাগ হলেন নারী। ফিলিপিন্স, ভারত, বাংলাদেশ, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি থেকে মেয়েরা যান সৌদি আরব-সহ পশ্চিম এশিয়ার দেশ, ইউরোপ, আমেরিকা ইত্যাদিতে। জেনিভা সনদ হয়তো কুটনীতিকের ঘরে নজরদারি চালাতে বাধা দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ঘরের কাজের ‘এজেন্সি’দের ওপর নজরদারির ব্যবস্থা করা তো সরকারের হাতেই রয়েছে, এবং সেই দাবিতে বহু সংগঠন বহু দিন ধরে সরব। মেয়েদের ঘরের কাজ, গৃহপরিচারিকাবৃত্তি এখনও শ্রমের সিঁড়িতে সবচেয়ে নীচে রয়েছে বলেই এঁদের নিয়ে শ্রমিক সংগঠনদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এঁদের সংখ্যা তো ফেলনা নয়। ২০১৫ সালের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের আর্থ-সামাজিক জাতপাতের সমীক্ষা বলছে, শুধু গ্রামাঞ্চলেই এখন ৪৪ লক্ষ ৮৪ হাজার মহিলা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। তা হলে আমাদের নগরায়ণের অনুপাতের হিসেবে এর অন্তত দুই থেকে আড়াই গুণ মেয়ের গৃহপরিচারিকা হিসেবে নগরাঞ্চলে কাজে যুক্ত থাকার কথা। অর্থাৎ, ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ১০ লক্ষ। এঁদের কাজের সুরক্ষা দেবে কে?
এঁদের জন্য যে প্রতিবাদ প্রত্যাশিত ছিল, তা দেখা যায়নি। হয়তো গৃহপরিচারিকা ঠিক নিজের ‘শ্রেণির’ মধ্যে পড়েন না বলে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো ছাড়া আর কোনও উদ্যোগ করেননি। কিন্তু এ বিষয়ে তৎপর হওয়া দরকার। লক্ষণীয়, ভারত এখনও বিশ্ব শ্রম সংস্থার ১৮৯ নম্বর কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। এই কনভেনশন গৃহপরিচারিকাদের কাজের কতকগুলি ন্যূনতম মৌলিক শর্ত নির্ধারণের কথা বলে: কাজের শর্ত, বেতন, ন্যূনতম ঘণ্টা, কাজের সময় সুরক্ষা, স্বাস্থ্য আর সামাজিক সুরক্ষার কথা বলে। এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করলে ভারত সরকার বাধ্য থাকবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আইন প্রণয়ন করতে। তা হলে কাজের নামে মানুষ পাচার বন্ধ করা আর গৃহপরিচারিকাদের কাজের সম্মান আর সুরক্ষার দিকে হয়তো আমরা একটু এগোতে পারব। বিশ্ব শ্রম সংস্থার শর্ত অনুযায়ী ২০১৬ সালের মধ্যে এই সনদে স্বাক্ষর আবশ্যক। ভারত যাতে এতে স্বাক্ষর করে, সে জন্য দাবি তোলা জরুরি।