—প্রতীকী চিত্র।
দিনান্তে শাকান্ন ভোজন করিয়া নিজগৃহে যিনি সুখে নিদ্রা যান তিনি সুখী হইতে পারেন, দীর্ঘায়ু হইবেন না। নূতন সমীক্ষা দেখাইয়াছে, দরিদ্র মানুষের প্রত্যাশিত আয়ু ধনীর তুলনায় কম। কত কম? গবেষকরা বলিয়াছেন, বার্ষিক এক লক্ষ টাকার উপর পারিবারিক রোজগার যে পুরুষদের, তাঁহারা গড়ে পাঁচ বছর বেশি বাঁচিবেন দরিদ্রতর (বছরে পঞ্চাশ হাজারের কম পারিবারিক রোজগার) পুরুষদের তুলনায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য তিন বৎসরের। আরও গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক শিক্ষা। অক্ষর পরিচয়হীন পুরুষদের চাইতে সাড়ে পাঁচ বছর অধিক বাঁচিবার আশা করিতে পারেন সাক্ষর পুরুষেরা। বর্ণ এবং ধর্ম দিয়াও প্রত্যাশিত আয়ুর হিসাব কষা চলে। ভারতে উচ্চবর্ণ হিন্দুদের বাঁচিবার আশা সর্বাধিক, অ-হিন্দুদের এবং দলিত-আদিবাসীদের আয়ু তুলনায় কম। কিন্তু শিক্ষা কিংবা সম্পদের তুলনায় বর্ণ-ধর্মের প্রভাব কম, বলিতেছেন গবেষকরা। এই ফল খুব চমকপ্রদ, এমন নহে। অধিক সম্পদের সহিত উন্নত জীবন, এবং উন্নত জীবনযাত্রার সহিত দীর্ঘ আয়ু যে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত, তাহা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোধগম্য। কিন্তু সম্পদহীনতা, শিক্ষাহীনতা মানুষকে কতখানি বিপন্ন করিতেছে, তাহার পরিমাপ সহজ নহে। সাধারণত শিশুর মৃত্যুহার, অপুষ্টি, এবং জননীর অপুষ্টি-অস্বাস্থ্য মাপিয়া দরিদ্রের উন্নয়নের বহর মাপা হয়। কিন্তু সম্পদ যে দরিদ্রের প্রত্যাশিত আয়ুর নিশ্চিত নির্ণায়ক হইতে পারে, তাহা এমন স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন ছিল।
প্রত্যাশিত আয়ু উন্নয়নের একটি মৌলিক সূচক। ভারত স্বাধীন হইবার সময়ে গড় প্রত্যাশিত আয়ু ছিল বত্রিশ বৎসর। আজ তাহা প্রায় পঁয়ষট্টি বৎসর অতিক্রম করিয়াছে। এই সাফল্য নগণ্য নহে, কিন্তু চিন্তা জাগায় ইহার মধ্যে আয়ুর হেরফের। কিন্তু সেই চিন্তা কী সূত্রে প্রবাহিত হইবে? সম্পদ ও শিক্ষার সহিত আয়ুর সম্পর্ক ধরা পড়িলেও, সেই সম্পর্ক সরল নহে। শিক্ষার সহিত দারিদ্রের সম্পর্ককে বলা চলে চক্রাকার। দারিদ্রের জন্যই শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকিতে চায়, এবং অসম্পূর্ণ শিক্ষা ফের দারিদ্রের দিকে ঠেলিয়া দেয়। অতএব দরিদ্রকে বাঁচাইতে হইলে হাসপাতালের চাইতে বিদ্যালয় কম গুরুত্বপূর্ণ নহে, ইহা হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে নীতি নির্ধারকদের। বহু ব্যয়ে মস্ত হাসপাতাল করিয়াও উন্নয়ন হইবে না, যদি স্কুল ও শিক্ষকের জন্য যথাযথ বিনিয়োগ করা না যায়। সম্পদের অভাব ঠিক কী কী উপায়ে আয়ু হ্রাস করে, তাহা লইয়াও বিস্তর মাথা ঘামাইয়াছেন গবেষকরা। তাঁহাদের সিদ্ধান্ত, দরিদ্রের জন্য চিকিৎসার সুযোগ কম, তাঁহাদের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস বেশি, পরিবেশগত ঝুঁকিও দরিদ্রের অধিক। রোজগারের অনিশ্চয়তা মনের উপর যে চাপ সৃষ্টি করে, তাহাও স্বাস্থ্যহানির কারণ।
ভারতে দারিদ্র কমিয়াছে, কিন্তু কর্মনিযুক্তির সম্ভাবনাও কমিতেছে। যে ধরনের কাজের সহিত দরিদ্রেরা অধিক সংযুক্ত, সেই কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প কিংবা অদক্ষ শ্রম, কোনওটিতেই রোজগার বাড়ে নাই। ফলে দরিদ্রের জীবনের মানের উন্নয়নে রাষ্ট্রের নীতির ভূমিকা আরও বাড়িতেছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সহিত রোজগার সহায়তা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আরও বিবেচনা করিয়া ব্যয় করিতে হইবে রাষ্ট্রকে, যাহাতে জীবনযাত্রার চাপ জীবনের দৈর্ঘ্য না কমাইতে পারে। ‘দীর্ঘায়ু হও’ এই শুভকামনায় সকল দেশবাসীর সমান অধিকার।