ছটপুজো, প্রতি বছরই আমরা যারা গঙ্গাতীরে বাস করি, তাদের কাছে খুব পরিচিত একটি পার্বণ। প্রায় সারা রাত ধরে তাসা এবং হিন্দি ফিল্মি গান সহযোগে পটকা ফাটাতে ফাটাতে ঘুমন্ত পল্লিকে উৎসবের মহিমা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে গঙ্গার ঘাটে যান পুণ্যার্থীরা। একটি দু’টি দল গেল, ভাবলাম শেষ, আর হবে না। যেই ঘুম এল, অমনই আর এক দল। এই ভাবে সারারাত। বাড়িতে শিশু বা বয়স্ক মানুষ, কিংবা রোগী থাকলে, অবস্থা শোচনীয়। বস্তুত নাগরিকের যে শান্তিতে ঘুমোবার অধিকার আছে, এটাই আমরা ভুলে গিয়েছি।
এই অভিজ্ঞতা বছরের পর বছর। শুধু ছট নয়, শিবরাত্রি থেকে কার্তিক বা শীতলা পুজো, নানা ব্রত সব কিছুতেই ‘আস্তিক্য’-এর এই সরব ঘোষণায় সাধারণ নাগরিককে যে মূল্য চোকাতে হয় সেটা প্রশাসনের ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না।
কিন্তু এ বারের ছটপুজো উপলক্ষে রবীন্দ্র সরোবরে ঘটে যাওয়া উচ্ছৃঙ্খলতা, অরাজকতা আর গুন্ডাগিরির যে ছবি উঠে এসেছে, তার সঙ্গে আমাদের বিনিদ্র রজনীর কোনও তুলনাই চলে না। সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে পুজোর নামে এই গুন্ডামি, এবং তার সঙ্গে প্রশাসনিক অপদার্থতা। যারা প্রকাশ্যে তালা ভেঙে সংরক্ষিত এলাকায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢোকার সাহস দেখায়, এবং এই দুঃসাহস দেখানোর পরও তাদের কোনও জবাবদিহি করতে হয় না, বুঝতে অসুবিধে হয় না, তাদের পিছনে উৎসাহ তথা সাহস দেওয়ার লোকের অভাব নেই। প্রশ্ন হল, প্রশাসনের দায়টা ঠিক কী, যাতে আদালতের নির্দেশ মান্য করাও বাহুল্য বোধ হয়? ভোট যে একটা বড় কারণ, সেটা জানি। কিন্তু শুধুই কি ভোট?
বস্তুত এই পরিস্থিতি সহসা তৈরি হয়নি। অনেক দিন ধরে তিলে তিলে নাগরিক সমাজের সুস্থতার দাবিকে নানা ভাবে দমন করে, দলাদলির রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করে, সমস্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দলদাসে পরিণত করতে গেলে, সমাজবিরোধীদের হাতে হাত মেলাতেই হবে। আর সেই পরিণতির ছবি রবীন্দ্র সরোবরের ছটপুজো। একেবারে অঙ্কের মতো ধাপে ধাপে মিলে যায়। কে না জানে, গণতন্ত্র যে আইনের শাসনের কথা বলে, সেই শাসনব্যবস্থায় শাসক শাসিত উভয়েরই আইন মানা জরুরি।
কলকাতা শহরে বাস করতে হয় যাঁদের, তাঁরা জানেন, এখানকার কর্পোরেশন অনেক দিন ধরেই আদালতের নির্দেশ অমান্য করে থাকে। আদালত নির্দেশ দিয়েছিল, ফুটপাতের গাছের চার দিকে কোনও বেদি তৈরি করা যাবে না। এবং যেগুলি তৈরি হয়েছে, সেগুলি ভেঙে দিতে হবে। কোথাও কোথাও দু’একটি ভাঙা হলেও তার সংখ্যা খুবই কম। পুরনো বেদির সঙ্গে, এই নির্দেশের পর আবার নতুন করে বেদি তৈরি হয়েছে। মিডিয়া, নাগরিক সমাজ, সবাই মুখে কুলুপ এঁটেছে। অথচ এই বেদি আপাত ভাবে নিরীহ হলেও তারা গাছের প্রাণ সংশয় করে। শহরের রোগ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ওই বেদিতে ফেলা হয় যাবতীয় ছোট আকারের আবর্জনা। যেমন, গুটখার ছেঁড়া প্যাকেট, প্লাস্টিকের চা খাওয়া কাপ, ঠাকুরের পুজোর ফুল, ঠোঙা ইত্যাদি। বৃষ্টির জল পড়ে অবধারিত তৈরি হয় ডেঙ্গির আঁতুড়ঘর।
কলকাতার প্রায় সমস্ত রাস্তায় দু’ধারে রাতে প্রাইভেট গাড়ি, ট্যাক্সি, বেসরকারি বাস পার্কিং করা থাকে। এগুলো যে স্থানীয় শাসক দলের নেতাদের আয়ের উৎসও বটে, তা আমরা বিলক্ষণ জানি।
এক কালে ইংরেজের রাজধানী ছিল বলে, এই শহরের বাসিন্দারা যে-সব সুবিধা ধারাবাহিক ভাবে পেয়ে এসেছেন, তার মধ্যে একটা ফুটপাত। ফুটপাতকে মূলধন করে অর্থ রোজগার করার প্রবণতা আজকের নয়। কিন্তু এখন সেই প্রবণতা একেবারে লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে। টাইল বসানো থেকে চায়ের দোকান তো ছিলই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাতের হোটেল থেকে লজেন্স বিস্কুটের দোকান পর্যন্ত সব। উত্তর কলকাতার গলির গলি তস্য গলিতে এই ফুটপাত ভাড়া দেওয়া চলছে। কেবল পথচারীর কথা ভাবার দায়িত্ব কারও নেই। ঘিঞ্জি জনবসতি এলাকার ফুটপাতের ওপর মোটর সারাই আর রং হচ্ছে। শ্বাসের সঙ্গে বিষ টেনে নিচ্ছি।
কর্পোরেশন অফিসে গেলে, কর্মী-সঙ্কোচন টের পাই। কিন্তু আর কখনও অর্থাভাব আছে বলে মনে হয় না। বিশেষত লোক দেখানো কাজ তো চলছেই। ফুটপাত দখল করে হঠাৎ হঠাৎ স্থানকাল ভুলে একটা করে মূর্তি, বা হাতি, জিরাফ, সূর্যমুখীর গজিয়ে ওঠা দেখি— এই কদর্যতার নাম না কি সৌন্দর্যায়ন। কেন মানুষের সুস্থ ভাবে হাঁটার অধিকার কেড়ে নিয়ে এ সব তৈরি হচ্ছে? প্রশ্ন করার কেউ নেই। বিরোধীরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন এত রকম ভুল আর অনৈতিক কাজ করে গিয়েছেন যে তাঁদের প্রশ্ন করার যোগ্যতা হারিয়ে গিয়েছে। আর রাজনৈতিক দলের কাছে নাগরিক তার বক্তব্য বাঁধা রেখেছিল বলে রাজনৈতিক দলও তাদের কণ্ঠ বাতিল করে দিয়েছে।
প্রায় সর্বত্র আবর্জনা ফেলার জন্য অনেক টাকা খরচ করে ইমারত তৈরি হয়েছে। কিন্তু রাস্তা পরিষ্কার হয়নি। কোনও রাস্তায় আবর্জনা ফেললে, দেখার কেউ নেই, বলারও কেউ নেই। প্রসঙ্গত, নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলতে পারি। আমার রান্নাঘর সংলগ্ন রাস্তাটিতে হঠাৎই এক দিন সকাল থেকে এলাকার ঝাড়ুদাররা আবর্জনা ফেলতে শুরু করল, এবং সেই আবর্জনা দিনের পর সপ্তাহ, তার পর মাসাধিক কাল ধরে জমাই হয়ে চলল। পথচলতি মানুষ সেটাকে ভ্যাট ভেবে মূত্রত্যাগ করতে লাগলেন। এর ওপর দিয়ে বাসের চাকা গড়িয়ে গিয়ে বাকি রাস্তাকেও ভ্যাটের মধ্যে টেনে নিল। তার মধ্যে বৃষ্টি পড়ে আমাদের নরকদর্শন হল। স্থানীয় কাউন্সিলরকে ফোন করলে তিনি বললেন, সিইও’র সঙ্গে কথা বলুন। সিইও পরিষ্কার করিয়ে দিলেন। কিন্তু ক’দিন পর আবারও ফেলা শুরু হল। আবার ফোন। অনন্ত এক ইঁদুর-বিড়াল খেলা।
আইনশৃঙ্খলা রাজ্য বা কেন্দ্র, যার বিষয়ই হোক না কেন, শাসিতের আগে সেটা শাসকের মানা প্রয়োজন। কিন্তু সরকার কর্মসংস্থান করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে সব অনাচার ও বিশৃঙ্খলাকে মান্যতা দিয়ে চলবে, এটাই কি আমাদের গণতন্ত্রের ভবিতব্য?