ফাঁদ। আলুচাষিদের বিক্ষোভ, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১২ মার্চ।
চা ষির দারিদ্র কী করে দূর করা যায়? বামফ্রন্ট সরকার উত্তর দিয়েছিল, চাষিকে জমির অধিকার দাও। জমির পাট্টার হাত ধরে এসেছিল আরও নানা সুযোগসুবিধে: স্বল্পহারে সুদ, ভর্তুকিতে সার-বীজ, বিনামূল্যে বা অল্পমূল্যে বিমা। কিন্তু একুশ শতকে এসে বোঝা যাচ্ছে, আবার সে এসেছে ফিরিয়া। সুদপীড়িত, হতদরিদ্র চাষির একটা শ্রেণি তৈরি হয়ে গিয়েছে, নিয়মের ফাঁদে-পড়া সরকার যাদের ছুঁতেও পারছে না।
সিপিএম-এর বর্ধমান জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক মনে করেন, এই ‘ঠিকা চাষি’ (মুখের কথায় জমি ঠিকা নিয়ে, সম্পূর্ণ নিজের খরচে চাষ করেন যাঁরা) শ্রেণির উদ্ভব আট-দশ বছর আগে। ‘বামফ্রন্টের আন্দোলনের ফলে খেতমজুরদের মজুরি একটা স্থিতাবস্থায় আসে। তার পর দেখা গেল, খেতমজুররা বোরো চাষের সময় জমির একটা অংশ ঠিকা নিল।’ ক্রমশ ধান থেকে আলু, বোরো থেকে আমন, তার পর সব ধরনের চাষই করতে শুরু করল এই ঠিকা চাষিরা।
এখন এমন চাষি কত? অচিন্ত্যবাবুর মতে, বর্ধমানে জমির মালিক, যিনি নিজে বা খেতমজুর দিয়ে চাষ করান, এমন চাষি ৫০ শতাংশ। বর্গাদার ২৫ শতাংশ। ঠিকাচাষি বাকি ২৫ শতাংশ। ‘‘খেতমজুরদেরই এক অংশ ঠিকা নিচ্ছে,’’ বললেন তিনি। তাঁর আন্দাজ মিলে গেল জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের সঙ্গে। জেলার কৃষি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেলাশাসক বললেন, জেলায় নথিহীন বর্গাচাষি অন্তত ২৫ শতাংশ। জামালপুরের চকদিঘি সমবায় সমিতির (যার সদস্য প্রয়াত ঠিকাচাষি সুশান্ত রুইদাসের জমিমালিক তারক সাহানা) সভাপতি গৌরাঙ্গ মুখোপাধ্যায়ের আন্দাজ, ভূমিহীন খেতমজুর ঠিকাচাষি অন্তত ৩০ শতাংশ, আর প্রান্তিক চাষি যাঁরা বাড়তি জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন, এমন অন্তত ১৫-২০ শতাংশ।
হরেদরে অর্ধেক চাষি জীবিকার জন্য ঠিকার উপর নির্ভর। প্রশাসনের খাতায় যাঁরা খেতমজুর, যাঁরা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, তাঁদের একটা বড় অংশই ঠিকাচাষি। চাষের শ্রম ও আর্থিক বিনিয়োগের অনেকটাই তাঁদের। ঠিক কতটা, সে তথ্য কারও কাছে নেই। তবে চাষে বিনিয়োগ হয় যে টাকা, তার অনেকটাই যে মহাজনি ঋণ, তার ইঙ্গিত মেলে। বর্ধমানের লিড ব্যাঙ্ক ইউকো ব্যাঙ্ক। কৃষিঋণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুজিত সরকার জানালেন, খাতায় রয়েছেন পাঁচ লক্ষ চাষি। কিন্তু মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ স্রেফ ২৫ হাজার টাকা। বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কেও খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চলতি মরসুমে (এপ্রিল-জুলাই, ২০১৫) যত চাষি ঋণ নিয়েছেন, তাঁদের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২০,৩৮৪ টাকা।
ঠিকাচাষি বর্গাদার নন। জমি চাষের আইনি অধিকার আছে বর্গাদারের, তাই বর্গা রেকর্ড দেখিয়ে তিনি ঋণ থেকে বিমা, সবই পাবেন। ঠিকাচাষির কোনও আইনি অধিকার নেই জমিতে। ভাগচাষির জমির অধিকার নেই, কিন্তু বিনিয়োগও তিনি করেন না। করেন জমির মালিক। চাষের সব কাজ দেখাশোনার জন্য ভাগচাষি নেন ফসলের অর্ধেক। ঠিকাচাষি কিন্তু চাষের জমিতে বিনিয়োগ করেন ১০০ শতাংশ। সাধারণত চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে। বিঘে প্রতি ৭০-৭৫ বস্তা আলু উৎপন্ন হলে, খেতমালিককে চার বস্তা দিয়ে, বাকিটা তাঁর থাকে। বাজার ভাল থাকলে সব ধার চুকিয়েও তাঁর হাতে থাকে কিছু টাকা, যেমন ছিল ২০১৪-১৫ সালের আলু মরসুমে। পরের মরসুমেই বিঘে প্রতি প্রায় ৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। পরপর দুটো মরসুম ক্ষতি হলেই কার্যত মারা পড়ে ঠিকাচাষি, গলায় কীটনাশক ঢালুক আর না-ই ঢালুক। তাহলে কেন চাষ করা? ‘আশায় বাঁচে চাষা’ কথাটা অনেকেই শোনালেন। যদি সারা বছরের চালটুকু মিলে যায়, যদি এ বার আলুর বাজার ভাল হওয়ায় আগের ধার শোধ হয়ে যায়, হাতে কিছু টাকা আসে সেই আশায় চাষ করে চাষি।
এ এক ধরনের ফাটকা তো বটেই। প্রাণ বাজি রেখে চাষ। কিন্তু কথা হল, চাষ যাঁদের জীবিকা, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক যদি ফাটকায় নামতে বাধ্য হ’ন, তা হলে কি চাষির চরিত্রদোষ খুঁজব? নাকি খুঁজব, কেন ফাটকা না খেললে চাষ করা যাচ্ছে না? ঠিকাচাষির জন্য তবে কী করছে রাজনীতি? কী করছে ব্যাঙ্ক, সমবায়?
করার আছে অনেক কিছুই। ভূমিহীন চাষিরা ব্যাঙ্কের অধীনে ‘জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ’ তৈরি করে নাবার্ডের ঋণ পেতে পারে। কিন্তু চাষের খাস জেলা বর্ধমানে তেমন গ্রুপ নেই বললেই চলে। কেন নেই? শুনে একটি সমবায় সমিতির কর্তা হাসলেন। বললেন, ‘‘বর্ধমান সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের কর্মীরা বসিরহাট, দমদম, বেহালার লোক। জামালপুরের ঠিকাচাষিদের গ্রুপ তৈরি করে ঋণ দেওয়া গেল কিনা, তা নিয়ে কেন মাথা ঘামাবেন? তাঁরা ট্রান্সফার হওয়ার চেষ্টায় আছেন।’’
বর্ধমানের সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে গিয়ে জানা গেল, সমবায় থেকে যাঁরা কৃষিঋণ নিতে পারেন, তাঁদের মধ্যেও মৌখিক ঠিকাচাষি (‘ওরাল লেসি’) বলে একটি শ্রেণি রয়েছে। জমির মালিক শুধু যদি লিখে দেন, অমুক আমার জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছে, তবে ১৬ শতাংশ সুদের মহাজনি ঋণের জায়গায় ৪-৭ শতাংশ সুদে কৃষিঋণ পেতে পারে ঠিকাচাষি। কত ঠিকাচাষির কাছে তেমন নথি আছে? ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান জওহরলাল মুখোপাধ্যায় জানালেন, ২০১৪-১৫ সালে কৃষিঋণ নিয়েছেন ১ লক্ষ ৫৫ হাজার চাষি। তাঁদের মধ্যে ‘মৌখিক ঠিকাচাষি’ ১৮ হাজার ৩০৪। মানে ১২ শতাংশ।
বাস্তবে ঠিকাচাষি যখন প্রায় ৫০ শতাংশ, তখন সমবায়ের খাতায় কেন এত কম? দুটো উত্তর পাওয়া গেল। এক, পর পর তিন বছর কোনও ব্যক্তি একই জমিতে ঠিকাচাষ করছে, প্রমাণ দেখাতে পারলে সে বর্গার জন্য আবেদন করতে পারে। তাই লেখাপড়া করে ঠিকা দিতে চান না জমির মালিক। আর দুই, জমির মালিক স্বল্প সুদের লোভে নিজেই ওই জমির জন্য কিষাণ ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নেন। স্রেফ ফিক্সড ডিপোজিট রাখলেও লাভ। শোনা গেল, ঠিকাচাষিদের মধ্যে মহাজনি কারবারও চলে ‘কেসিসি’-র টাকায়। সরকারের থেকে ৪ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে ঠিকাচাষিদের মধ্যে ১৬ শতাংশ হারে খাটানো হচ্ছে। চাষির জন্য ভর্তুকির এই হল গতি।
যার কেউ নেই, তার আছে রাজনীতি। সরকারি সুবিধে যাতে প্রকৃত চাষি পায়, তার জন্য নেতারা কী করছেন? সিপিএম নেতা অচিন্ত্য মল্লিক, জামালপুরের তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ প্রদীপ পাল, দু’জনেই বললেন, পঞ্চায়েতে বীজ, সার এলে পঞ্চায়েত সদস্য মধ্যস্থতা করে মালিকের ভাগের জিনিস কিছুটা পাইয়ে দেন ঠিকা চাষিকে। ‘‘একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকে,’’ বললেন অচিন্ত্যবাবু। সোজা কথায় যার মানে, সরকারি অনুদান আর গরিব চাষির মধ্যের জায়গাটুকু আনুগত্যের পরিসর, অধিকারের নয়।
রাজনীতি অধিকার দিতে পারলে জমির মালিক ঠিকাচাষির সঙ্গে লিখিত চুক্তি করতে বাধ্য হত। নয়তো সমবায় কর্তা, পঞ্চায়েত সদস্যরা লিখে দিতেন, সুশান্ত রুইদাস চাষি। তা দেখিয়ে ঋণ মিলত সমবায় থেকে। কিন্তু এখন সমবায়ের কর্তারাও জমির মালিক। দলের নেতারাও। তারা সুশান্তদের কেউ নয়। অচিন্ত্যবাবু বললেন, ‘‘ঠিকাচাষি বেশি বিপন্ন। তবে তাদের জন্য আলাদা কোনও কর্মসূচি নয়। সব চাষির জন্য এক আন্দোলন।’’ সেটা কী? সরকারকে ফসলের সহায়কমূল্য বাড়াতে হবে, যাতে জমির মালিক চাষে ফের উৎসাহী হয়। তাতে ঠিকাচাষির কী সুবিধে? ‘‘তাকে পাট্টা পাওয়ার জন্য আন্দোলন করতে হবে।’’
আরও দার্শনিক কথা বললেন ভাতাড়ের বিধায়ক বনমালী সরকার, ‘‘এই চাষিদের কী হবে, এ হল চিরন্তন প্রশ্ন। মা মাটি মানুষের সরকার এদের জন্য ভাবছে।’’ কী ভাবছে? ‘‘কে কী চাষ করবে, সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তৈলবীজ, ভুট্টা...’’ কিন্তু বিকল্প চাষ করেও বা ঠিকাচাষির সুবিধে কোথায়? গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন বনমালীবাবু। তাঁর নিজের সাতটি ধানের মরাই, তিনটি পুকুর, ৬০ বিঘে জমি, পাঁজা করে রাখা সারের বস্তা, কোথাও উত্তর মিলল না।
ঠিকাচাষিদের পাশে যে রাজনৈতিক দল নেই, তা স্পষ্ট করে দিলেন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন। বললেন, ‘‘বহু দাবি নিয়ে লোকে ডেপুটেশন দিতে আসে। ‘ওরাল লেসি’-দের দাবি নিয়ে কেউ আসে না। ওঁরা সংগঠিত নন। কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনও আছে বলে চোখে পড়ছে না।’’
যে বাজার ধরতে পারে না, নেতাও ধরতে পারে না, তার মরা ছাড়া গতি কী?
তথ্য সহযোগিতা: সৌমেন দত্ত, গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, উদিত সিংহ