এক নির্লজ্জ প্রহসন

গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখালেই এখন চাণক্যের তকমা মেলে

মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে কোনও দল বা জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিজেপি ও শিবসেনা মিলে জোট বেঁধে ভোটে লড়েছিল। ২৮৮ আসনের বিধানসভায় সরকার গঠনের জন্য দরকার ১৪৫টি আসন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৯ ০০:২১
Share:

ঘরশত্রু? এনসিপি-র সমর্থকরা তাঁদের বিতর্কিত নেতা অজিত পওয়ারের কুশপুত্তলিকা দাহ করতে ব্যস্ত, সোলাপুর, ২৩ নভেম্বর। পিটিআই

ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংবিধানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে হবে, এমন কথা চাণক্য বলেননি। বলেননি, গদি ধরে থাকার জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে যথেচ্ছ কাজে লাগাতে হবে। চাণক্য গণতান্ত্রিক নির্বাচনের রায়কে হাস্যকর পর্যায়ে নামিয়ে এনে রাতের অন্ধকারে সিংহাসন দখলের কথাও বলেননি। চাণক্যের দুর্ভাগ্য, অধুনা ভারতীয় রাজনীতিতে সেই কাজগুলি করলেই ‘আধুনিক চাণক্য’-এর তকমা মিলছে।

Advertisement

মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে কোনও দল বা জোটই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিজেপি ও শিবসেনা মিলে জোট বেঁধে ভোটে লড়েছিল। ২৮৮ আসনের বিধানসভায় সরকার গঠনের জন্য দরকার ১৪৫টি আসন। বিজেপি-শিবসেনা মিলে পেয়েছে ১৬১টি আসন। মানুষ বিজেপি-শিবসেনা সরকার গঠনের পক্ষেই রায় দিয়েছে বলা যায়। উল্টো দিকে কংগ্রেস ও এনসিপি জোট বেঁধেছিল। দু’দল মিলিয়ে সরকার গঠনের অবস্থান থেকে বহু দূরেই থেমে গিয়েছে। অর্থাৎ, মহারাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চাননি কংগ্রেস-এনসিপি-র সরকার গঠন হোক।

ভোটের পরে কী হল? মুখ্যমন্ত্রীর গদি নিয়ে বিজয়ী জোটের দুই শরিকের মধ্যে বিবাদ শুরু হল। বিজেপির সঙ্গে দরকষাকষিতে কল্কে না পেয়ে শিবসেনা এনসিপি ও কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে সরকার গঠনের চেষ্টা শুরু করল। এনসিপি ও কংগ্রেসও নিজের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শ’ বিসর্জন দিয়ে শিবসেনার সঙ্গে এক টেবিলে বসল। তিন দল মিলে হয়তো বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেলে। কিন্তু ভুললে চলবে না যে মহারাষ্ট্রের মানুষ এই তিন দলের সরকার গঠনের পক্ষে রায় দেননি।

Advertisement

ভোটারদের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে, তা অমান্য করে শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেস মিলে সরকার গঠনের চেষ্টা রাজনৈতিক ভাবে অবশ্যই অনৈতিক। কিন্তু তিন দলের বিধায়কসংখ্যা যে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য যথেষ্ট, তাতে ভুল নেই। সেটা আটকাতে রাতের অন্ধকারে এনসিপি-র কিছু নেতাকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপির গদি দখলকে শুধু সমান অনুচিত বলাটা যথেষ্ট নয়, তা অনেক বেশি অনৈতিক।

মহারাষ্ট্র দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ কিনা হবে ভোরবেলা, চুপি চুপি? কেন? কেন রাজ্যপালের কাছে সরকার গঠনের দাবি জানানো হবে মধ্যরাতে? রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে ভোররাতে? যাতে অন্য দলের বিধায়ক ভাঙিয়ে আনায় কোনও সমস্যা না হয়?

বিধায়ক কারা? প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাররা যাঁদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে বিধানসভায় পাঠাচ্ছেন। তাঁরা মানুষের কল্যাণে নীতি প্রণয়ন করবেন। তাঁরা কি বাজারের আলু-পেঁয়াজ? চাইলেই যে কেউ কিনে নিতে পারেন? চাইলেই কেউ ঝোলায় পুরে বা বিমানে বসিয়ে নিজের শিবিরে নিয়ে যেতে পারেন? পাঁচতারা হোটেলে তালাবন্দি করে না রাখলে বিধায়কদের যে কেউ ‘কিডন্যাপ’ করে নিয়ে যেতে পারেন? বিধায়করা কি স্বাধীন ভারতের নাগরিক নন? যদি তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কোনও সিদ্ধান্তই নিতে না পারেন, যদি তাঁদের চাপ দিয়ে বা অর্থের লোভ দেখিয়ে যে কোনও কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব, তা হলে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাররা কিসের ভিত্তিতে তাঁদের ভোট দিয়ে বিধানসভায় পাঠালেন? নিজেদের নিলামে তুলবেন বলে?

দেশের রাজনৈতিক পরিসরের আলোচনায় এখন অন্য দলের বিধায়ক ভাঙিয়ে আনাটাই রাজনীতিতে ‘মাস্টারস্ট্রোক’। মানুষের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজ্যে রাজ্যে সরকার গঠন করে ফেললেই এখন ‘আধুনিক চাণক্য’-এর তকমা মেলে।

মণিপুর, গোয়া, কর্নাটকের মতো রাজ্যে বিজেপি এর আগেও ভোটের রায় না পেয়েও সরকার গঠন করেছে। দেশের রাজনীতিতে বিধায়ক কেনাবেচা, ভোটের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার গঠন তার আগেও হয়েছে। কর্নাটকেও ঠিক মহারাষ্ট্রের মতো বিজেপির বি এস ইয়েদুরাপ্পা আগেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিয়ে ফেলেছিলেন। পরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবেন না বুঝে পদত্যাগ করেন। যেমন এ বার মহারাষ্ট্রে ফডণবীসকে করতে হল। নৈতিক-অনৈতিক রাজনীতির মাঝের গণ্ডিটা বিজেপি তাই ভাঙতে অভ্যস্ত। কিন্তু মহারাষ্ট্রের ঘটনাক্রম দেশের রাজনীতির বিবেককে আরও বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। এক ধাক্কায় মনে হয়, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল কেউই বোধ হয় সংবিধানের রক্ষাকর্তা নন— তাঁরা যেন কোনও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শরিক। মনে হয়, রাজনীতিতে ‘চক্ষুলজ্জা’ নামক শব্দের আর স্থান নেই।

রাজনৈতিক দল ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা করবে, রাজনীতিকরা ভোটে জেতার পরেই কেউ সমর্থনের বিনিময়ে দর হাঁকবেন, কেউ আবার নিজের নামে দুর্নীতির মামলা ধুয়েমুছে ফেলার বিনিময়ে সমর্থন দেবেন— হয়তো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ভরসা-স্থল ছিল রাজ্যপালের দফতরের মতো সাংবিধানিক সংস্থা। কোনও রাজ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপন্ন হলে বিরোধী দল থেকে নাগরিক সমাজ, বরাবরই রাজ্যপালের কাছে দরবার করেন। মহারাষ্ট্র দেখাল, সেই রাজ্যপালের দফতরও আর আশ্রয়স্থল নয়। বরঞ্চ রাজ্যপালের দফতরের দিকেই নীতি, বিবেকবুদ্ধি বিসর্জন দেওয়ার অভিযোগের আঙুল। কিসের ভিত্তিতে রাজ্যপাল দেবেন্দ্র ফডণবীসকে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ করতে ডাকলেন, তা যেমন অস্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে কত দিনের মধ্যে তিনি বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের নির্দেশ দিলেন, সেখানেও গোপনীয়তা। যে সরকার গঠনের জন্য মানুষ ভোট দিলেন, সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শপথ নিলেন পুরোটাই আমজনতাকে আক্ষরিক অর্থে অন্ধকারে রেখে।

এই নির্লজ্জ ঘোড়া কেনাবেচার চেষ্টা, ক্ষমতা দখলের নগ্ন রাজনীতি দেখে আর একটি প্রশ্নও মনে আসতে বাধ্য। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দল বোধ হয় আর কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করে না। নাগরিক সমাজের প্রতিরোধ বা সমালোচনারও কোনও মূল্য তাদের কাছে নেই।

বিজেপি কেন্দ্রে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার আগেই নিজেদের জন্য ‘ওয়াশিং মেশিন’-এর তকমা জুটিয়ে ফেলেছে। যত দুর্নীতির অভিযোগই থাক না কেন, সিবিআই-ইডি’র যত মামলাই থাক না কেন, বিজেপির গেরুয়া উত্তরীয় গলায় ঝুলিয়ে ফেললে আর কোনও চিন্তা নেই। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল থেকে শিবির বদল করা বা অন্ধ্রের তেলুগু দেশমের নেতারা সে কথা প্রমাণ করছেন। মহারাষ্ট্রে নিজের পরিবার ও দল ভেঙে বেরিয়ে আসা অজিত পওয়ারের বিরুদ্ধেও হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির মামলা চলছিল। তিনি বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার পরেই অনেক মামলার ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হল। সাফাই দেওয়া হল বটে যে ওই সব মামলায় শরদ পওয়ারের ভাইপোর নাম ছিল না। কিন্তু অনেকেই হয়তো ভোলেননি, মহারাষ্ট্রের ভোটের প্রচারে ফডণবীস ফের ক্ষমতায় এলে অজিত পওয়ারকে জেলের ঘানি টানতে পাঠাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। যেমন বিজেপির নেতারা এক কালে ধর্মতলার মোড়ে মুকুল রায়কে জেলে পাঠানোর হুঁশিয়ারি দিতেন।

দুর্নীতির অভিযোগে তিরবিদ্ধ দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারকে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন। তাঁর অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কি আশা করেন, যে সব অন্য দলের বিধায়ক নিজের নীতি-মতাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে টাকা বা ক্ষমতার লোভে তাঁর দলকে সমর্থন করছেন, তাঁরা দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন চালাবেন? এবং, অমিত শাহ? আপনি কোনও ভাবেই চাণক্য নন। চাণক্য-নীতি ক্ষমতার লোভে নৈতিকতা বিসর্জনের কথা বলে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement