প্রশ্ন: কয়েক দিন আগে এক তৃণমূল কর্মী এক পুলিশ বড় কর্তার সঙ্গে দেখা করতে যান। তাঁর আর্জি ছিল, ‘‘আমাকে এবং আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দিন কারণ বিজেপির দুষ্কৃতীরা প্রতি দিন হুমকি দিচ্ছে, বলছে বিজেপিতে যোগ দিতেই হবে।’’ সংবাদটি পড়েই যে প্রশ্ন মাথায় এল তা হল, আমরা কি চেনা পশ্চিমবঙ্গে বাস করছি না নতুন কোনও জায়গায়?
রণবীর সমাদ্দার এই একটি ঘটনাই এক বিরাট ও ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। এটা নিছক পট পরিবর্তন নয়, পট পরিবর্তন আগেও ঘটেছে— কংগ্রেস থেকে বামফ্রন্ট, বাম ফ্রন্ট থেকে তৃণমূল। কিন্তু এ বারে যা ঘটতে চলেছে, তা সত্যি ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। অতীতের পরিবর্তনের সঙ্গে এর কোনও তুলনাই চলে না, অর্থাৎ এই পরিবর্তন অ-ভূতপূর্ব। আগে বিধায়ক ও পুরপ্রধানেরা দল ত্যাগ করে অন্য দলে গিয়েছেন, তার ফলে কোনও দলের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, কোনও দলের শক্তি হ্রাস— ব্যস, এই পর্যন্ত। কিন্তু এ বারে তৃণমূল থেকে যাঁরা বিজেপিতে যাচ্ছেন, তাঁরা বাধ্য হবেন একটি নতুন ও ভিন্ন রাজনীতি, একটি নতুন ভাবাদর্শ ও কর্মকাণ্ডের শরিক হতে, অথবা স্বেচ্ছায় এই নতুন পথের শরিক হবেন যে পথের সঙ্গে তাঁদের পুরনো রাজনীতির কোনও মিল নেই। দলত্যাগের স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও জনজীবনকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করছে। এবং এ শুধু তৃণমূলের প্রশ্ন নয়, অন্য দল থেকে যাঁরা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও সত্য। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অনুসারীরা যখন পালাবদলের পর দলে দলে নতুন আগ্রাসী রাজনীতিতে গেলেন, সেই বছরগুলির কথা খেয়াল আছে?
প্র: নির্বাচনের আগে ও পরে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে সংঘাত হয়েই চলেছে। কী এর পরিণাম?
উ: হিংসার ঘটনাটার উপর ততটা গুরুত্ব দিচ্ছি না আমি। খেয়াল করা দরকার যে, হিংসা আসলে অন্য কিছুর দ্যোতক এবং ইঙ্গিতবাহী; কেন্দ্রে আসীন এই সর্বময় শক্তি আসলে চায় পশ্চিমবঙ্গকে সম্পূর্ণত নিয়ন্ত্রণে আনতে। অর্থাৎ এই নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতে হিংসা বা ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্য ও ভূমিকা আলাদা। লক্ষ্য হল ত্রাসের মাধ্যমে বাংলার মাথা নত করানো। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, পশ্চিমবঙ্গে সংঘটিত হিংসাকে মূল্য দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু মুজফ্ফরপুরের দাঙ্গায় যে ষাট জন প্রাণ হারালেন, বা নাগরিক পঞ্জির প্রতিবাদে যে চৌত্রিশ জন অসমে আত্মহত্যা করলেন, তাঁদের সম্পর্কে বিজেপি বা অন্যরা কিছুই বলছে না। অন্য দিকে বাংলায় নিহত বিজেপি কর্মীদের পরিবারকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শপথ অনুষ্ঠানে। খেয়াল রাখবেন, অতি সম্প্রতি তাঁর দু’টি বিজয় ভাষণে নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ উল্লেখ করেছেন। কেন করেছেন? কারণ হল, পশ্চিমবঙ্গ এত দিন ধরে গোবলয়ের বাইরে ছিল, এ বার প্রয়াস চালানো হবে তাকে মূল ভারতীয় প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করার। অন্য ভাবে বললে, ভবিষ্যতে যেন পশ্চিমবঙ্গের নাম বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
প্র: মূল প্রবাহ বলতে আপনি ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?
উ: বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের স্বদেশ নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ভাবনা আছে। আপনি ব্যক্তিগত স্তরে সেই ভাবনাকে মূল্য না-ও দিতে পারেন, কিন্তু সেই চিন্তা ও ভাবনার পরিক্রম দিন দিন বাড়ছে। এই ভাবনার নির্যাস হিন্দুত্ব নির্দেশিত ভারতীয়তায়, উগ্র জাতীয়তাবাদে এবং এক বিশেষ ধরনের দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ সন্নিহিত। বিজেপির দাবি বাংলাকেও এই দেশাত্মবোধের শরিক হতে হবে। এর আগে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, বামফ্রন্ট, তৃণমূল, কোনও দলই এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি।
প্র: তা হলে বলতে পারি যে দুর্ভাগ্যক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস এই নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন?
উ: ঠিক। এবং এ-ও ঠিক যে এই সঙ্কট মোচনের তাৎক্ষণিক সমাধান তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে নেই। এখনও পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস অন্যান্য আঞ্চলিক দলের মতো নিজের রাজ্যের সীমানার মধ্যেই অবস্থান করছে, কোনও বিশেষ ধরনের জাতীয় ভাবনা বা মতাদর্শ দ্বারা প্রণোদিত হয়নি। আরও স্পষ্ট করে বললে, সারা দেশকে কেন্দ্র করে কোনও সামগ্রিক চিন্তা, কল্পনা, ভাবাবেগ এই দলকে এত দিন অনুপ্রাণিত করেনি। তৃণমূল ছিল একান্তই আঞ্চলিক এবং তার রাজনীতি ছিল নীচের মহল থেকে উঠে আসা মানুষের রাজনীতি— তার ভালমন্দ মিলিয়ে। এখানে দেশ, জাতীয়তাবাদ, বিদেশনীতি ইত্যাদির জায়গা ছিল না। সঙ্কট ঠিক এইখানে। তা হলে কী ভাবে সে এই জাগ্রত ভারতীয়তার মোকাবিলা করবে? আসলে বিজেপি সুসংহত ভাবে যে চেষ্টাটা চালাচ্ছে, মাত্র তিনটি রাজ্যে তা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি— পশ্চিমবঙ্গ, কেরল ও কাশ্মীর। তাই নরেন্দ্র মোদী তাঁর ভারতীয়তা-সর্বস্ব ভাষণে এই
তিনটি রাজ্যের নাম ব্যতিক্রম রূপে বারংবার উচ্চারণ করেছেন।
প্র: এই প্রসঙ্গে কি আন্তোনিয়ো গ্রামশির ‘হেজিমনি’র তত্ত্বের কথা মনে করা যেতে পারে?
উ: সত্য ঘটনা হল, গ্রামশি না পড়েই বা না বুঝেই এই সর্বব্যাপী আগ্রাসী শক্তি ভারত জুড়ে যে একাধিপত্যের বিস্তার ঘটাতে সক্রিয় হয়েছে, তার সঙ্গে হেজিমনি প্রতিষ্ঠার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই সার্বিক দেশব্যাপী আবেদনের বিকল্প-নির্মাণ ডিএমকে বা বিজেডি বা তৃণমূলের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলির পক্ষে প্রায় অসম্ভব, যদি না তারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে রাষ্ট্র, দেশ ও জাতি নিয়ে এক বিকল্প ভাবনা হাজির করতে পারে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, নোটবন্দি ও জিএসটি এই সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে কোনও প্রভাবই রাখতে পারেনি, এই সব কিছুকে অতিক্রম করে বিজয়ী হল এক নতুন ধরনের আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদ। বিজেপির নেতা মুকুল রায়ের একটি মন্তব্যে এই ঘটনার স্পষ্ট প্রতিফলন আছে। তিনি বলেই দিয়েছেন যে, আঞ্চলিক দলগুলি তাদের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, এবং আরও হারাবে। উপরন্তু, দেশপ্রেমের ধ্বনি তুলে সমগ্র ভারতকে হিন্দুত্বের পুণ্য আধারে রূপান্তরিত করা হবে। এই যে বিরাট দেশব্যাপী কর্মযজ্ঞ, তাতে ‘মা-মাটি-মানুষ’এর কোনও ভূমিকা থাকবে না, নতুন দেশমন্ত্রের উচ্চারণ আঞ্চলিক মানসকে পাত্তাই দেবে না। সোজা কথায়, অবাধ্য দুর্বিনীত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গকে শিক্ষা দেওয়া হবে। কেন অবাধ্য বা দুর্বিনীত? কারণ তারা মনে করে, প্রথমত, মমতা ও তাঁর দল মুসলমান তোষণে মত্ত; দ্বিতীয়ত এই রাজ্য দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছে। তৃতীয়ত, এই রাজ্যে হিংসার বাতাবরণ একটি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, যার দৃষ্টান্ত কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত পঞ্চায়েত নির্বাচন।
উল্টো দিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দল যে হেতু গড়ে ওঠে জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, তার সাংগঠনিক ক্ষমতা এ ক্ষেত্রে বড় কথা নয়। বড় কথা হল, জন-আবেদন। কিন্তু শুধুমাত্র এই জন-আবেদনের উপর ভর করে হিন্দুত্ব-অনুপ্রাণিত সংগঠিত জাতীয়তাবাদকে কত দূর ঠেকানো যাবে, সেটাই প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গ এখন গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন। এই দুরূহ পরিস্থিতিতে, তাঁর প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যাকরণ পরিত্যাগ করে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ— এক দিকে তাঁর রাজনৈতিক সত্তার পুনর্নির্মাণ, অন্য দিকে জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার কঠিন প্রচেষ্টা। সমাজের নীচের শ্রেণিকে ভিত্তি করে যে জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, তার পক্ষে কি এই মৌলিক পুনর্নির্মাণ সম্ভব হবে?
প্র: এই সংলাপের উৎসমুখ ছিল নির্বাচনের ফলাফল। তাই নির্বাচনের প্রসঙ্গেই শেষ প্রশ্ন। ভারত জুড়ে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এতটা সাফল্য লাভ করবে, এ কি তবে প্রত্যাশিতই ছিল?
উ: না, বিজেপির জয় যে এতটা সর্বাঙ্গীণ এবং নাটকীয় হবে, তা প্রত্যাশিত ছিল না। অনুমান করা যেতে পারে, সিপিএমের বহু নেতা, কর্মী আর তাঁদের অনুগামী সাধারণ মানুষের সমর্থন এ বারে বিজেপির দিকে গিয়েছে। বিভিন্ন স্তরের পার্টির নির্দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ভোট স্থানান্তর হয়েছে, এমনও সম্ভব। এর মূলে সম্ভবত আছে জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সংসদীয় বামপন্থীদের অবজ্ঞা ও অন্ধ আক্রোশ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেমন দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলন সক্রিয়, ঠিক তেমনই দরিদ্র মানুষজন এবং ক্ষুদ্র উৎপাদক-অভিমুখী জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনও সক্রিয়। এই শ্রেণি-বিশ্লেষণ না করে জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলনের অন্ধ বিরোধিতা করে বামপন্থীরা নিজেদের ক্ষতি তো করেছেনই, তার উপর বাংলা তথা সমগ্র দেশেরও অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ‘প্যাসিভ রেভলিউশন ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ গ্রন্থের লেখক