গৌরবের ভাগিদার

আরও স্বাভাবিক হইল, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, পূর্বসূরির রাজনৈতিক রং বিচার না করিয়াই তাহারা এই গবেষণা প্রকল্পগুলিকে উৎসাহ দিয়া চলিবে। তাহার জন্য অর্থের জোগান অব্যাহত রাখিবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৯ ০০:০৬
Share:

চন্দ্রের দিকে হাত বাড়াইবার দুঃসাহসটি ভারত যখন প্রথম করিয়াছিল, অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে দেশটি তখন নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ। এক অনুন্নত দেশ মহাকাশ গবেষণার উদ্যোগ করিতেছে, গত শতকের মধ্যপর্বে ইহা সাধারণ ঘটনা ছিল না। সেই অ-সাধারণ উদ্যোগটির পিছনে ছিলেন জওহরলাল নেহরু। কেবলমাত্র দেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে নহে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গবেষণায় তাঁহার কথা পৃথক ভাবে উল্লেখ্য বিজ্ঞানের প্রতি তাঁহার অদম্য বিশ্বাসের কারণেই। তিনি বিশ্বাস করিতেন, শুধুমাত্র বিজ্ঞান-প্রযুক্তিই একটি দেশকে, একটি জাতিকে ভবিষ্যতের পথে লইয়া যাইতে পারে। তিনি যে অভ্রান্ত ছিলেন, এই বৎসরই ইসরো তাহার দুইটি প্রমাণ পেশ করিল। স্যাটেলাইট-বিধ্বংসী মিসাইল উৎক্ষেপণের সাফল্যের পর দ্বিতীয় চন্দ্রযান উৎক্ষেপণ— মহাকাশ-প্রযুক্তিতে ভারতের প্রশ্নাতীত অধিকারের কথা ঘোষণা করিতেছে। কিন্তু, সেই কৃতিত্ব কাহার? যাঁহার উদ্যোগে এই গবেষণার সূচনা, তাঁহার; না কি, যাঁহার শাসনকালে ইসরো এই সাফল্যগুলি অর্জন করিল, তাঁহার?

Advertisement

তর্কটিই অবান্তর। এই গোত্রের কৃতিত্বের মালিকানা বিচার সম্ভব নহে, কারণ সাফল্যটি ভারতের। কোনও ভৌগোলিক পরিসীমা অর্থে ভারত নহে, উত্তরাধিকারের অর্থে ভারত। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ন্যায় ক্ষেত্রের গবেষণা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ সময়ব্যাপী সাধনার ফসল। সেই সময়কালে দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটা অপ্রত্যাশিত নহে, বরং স্বাভাবিক। আরও স্বাভাবিক হইল, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, পূর্বসূরির রাজনৈতিক রং বিচার না করিয়াই তাহারা এই গবেষণা প্রকল্পগুলিকে উৎসাহ দিয়া চলিবে। তাহার জন্য অর্থের জোগান অব্যাহত রাখিবে। ভারতও সেই স্বাভাবিক পথেই হাঁটিয়াছে। নেহরু-যুগের সমাজতন্ত্র হইতে নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহদের উদার অর্থনীতি, অটলবিহারী বাজপেয়ীর ভারত উদয় হইতে নরেন্দ্র মোদীর শাসন— এই দীর্ঘ যাত্রায় মহাকাশ-গবেষণার প্রশ্নটি কখনও সম্পূর্ণ অবহেলিত হয় নাই। ‘ইনকোস্পার’ হইতে ইসরো, মহাকাশ ছুঁইবার স্বপ্ন হইতে চাঁদের মাটিতে সফট ল্যান্ডিংয়ের সম্ভাবনা— ভারত বহু দূর আসিয়াছে। জাতি হিসাবে গর্বিত হইবার কারণ বিলক্ষণ আছে।

কিন্তু, সেই গর্ব সমষ্টির, এককের নহে। এইখানেই ভুল হইতেছে। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা বলিলেন, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেই এই সাফল্য অর্জিত হইয়াছে। এই মন্তব্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সম্ভবত আপত্তি নাই, কারণ সার্জিকাল স্ট্রাইক হইতে কৃত্রিম উপগ্রহ-বিধ্বংসী মিসাইল, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্ব দাবি করিয়াছেন। কখনও প্রত্যক্ষ ভাবে, কখনও পরোক্ষে। গৌরবের ভাগিদার সকলেই হইতে চাহেন, এবং যে দেশের রাজনীতি ইদানীং অতিজাতীয়তার রঙে রঞ্জিত, সেখানে এই গোত্রের কৃতিত্বের ভাগ লাভজনকও বটে। কিন্তু, কাজটি দুই অর্থে অনৈতিক। প্রথমত, সব কৃতিত্ব নিজের দিকে টানিলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়। ব্যক্তির ইতিহাস নহে; দেশের, জাতির ইতিহাস। দ্বিতীয়ত, এই গোত্রের প্রকল্পগুলির ব্যক্তিকেন্দ্রিক হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ভবিষ্যতে অন্য কোনও রঙের শাসক এই প্রকল্প হইতে নরেন্দ্র মোদীর নাম মুছিতে প্রকল্পটিকে অবহেলা করিলে ব্যক্তি মোদীর ক্ষতি সামান্য, ভারতের ক্ষতি অসামান্য।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement