আজও কেন কবিতা লেখা হয়

আমি মাইকের কাছে মুখ নামিয়ে আনতেই দুজন বলে উঠলেন, ‘দ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প পোয়েম’। আমেরিকাতে সে বার ফুলব্রাইট ফেলোশিপ-এ, অর্থাৎ সরাসরি ওদের সরকারি টাকায় আমি পাঁচ মাস ছিলাম।

Advertisement

সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৮ ০৬:০০
Share:

রাত বারোটায় কবিতা পড়তে ডাকা হয়েছিল আমাকে। স্থান: শিকাগো। সময়: তিন দিন বাদে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হবেন। গিয়ে দেখলাম প্রায় তিরিশ জন তরুণ মেক্সিকান কবি, তাঁদেরই আয়োজন, সঙ্গে এক জন রাশিয়ান কবি, এক জন পোল্যান্ডের, আর আমি একমাত্র ভারতীয়। কেন আমাকে ডাকা হয়েছে বুঝতে পারছিলাম না। একমাত্র অ-শ্বেতাঙ্গ বলে? সাড়ে বারোটায় আমার নাম ডাকা হল। জীবনে দ্বিতীয় বার মধ্যরাতে কবিতা পড়তে উঠলাম। প্রথম বার উঠেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে দিঘার সমুদ্রসৈকতে, যে অনুষ্ঠানের নাম ছিল— মধ্যরাতে বাংলা কবিতা।

Advertisement

আমি মাইকের কাছে মুখ নামিয়ে আনতেই দুজন বলে উঠলেন, ‘দ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প পোয়েম’। আমেরিকাতে সে বার ফুলব্রাইট ফেলোশিপ-এ, অর্থাৎ সরাসরি ওদের সরকারি টাকায় আমি পাঁচ মাস ছিলাম। কিন্তু কবিতাটা লিখেছিলাম, লিখে ছাপিয়ে দিয়েছিলাম, না লিখে পারিনি। ভোটের পাঁচ দিন আগে ট্রাম্প মেয়েদের নিয়ে একটি রুচিহীন মন্তব্য করেন। তত দিনে সারা আমেরিকা জেনে গিয়েছে ট্রাম্পই তাদের নিয়তি। একটা ছোট হলঘরে কয়েক জন কবি এক জন ভাবী রাষ্ট্রনায়ককে কবিতায় দেখতে চাইছেন, প্রতিরোধ করতে চাইছেন, মিডিয়ার চোখে, ইতিহাসের চোখে, সমাজের চোখে তার কোনও দাম নেই। ভিয়েতনামের সময় কলেজে কলেজে প্রতিরোধ হয়েছিল, কবিতা পড়া হয়েছিল, অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর কবিতায় আগুন ঝরেছিল সে দিন। কিন্তু লোকে বলেছিল কবিতা কি আর ভিয়েতনাম থামাতে পারে? পারে না, কিন্তু রাষ্ট্রসংঘই বা আছে কেন? তারাও তো ইরাক-আফগানিস্তান থামাতে পারেনি। আমি সে দিন শিকাগোয় তরুণ মেক্সিকান কবিদের ভেতর মধ্যরাতে যে আলো দেখতে পেয়েছি, সেটা আসলে সেই আলো, যেটা পাঁচ হাজার বছরেও নেভেনি। মেক্সিকানদের মুখের ওপর দেওয়াল তুলে দিতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প।

কোন আলো? পাঁচ হাজার বছর আগে এক জন শিকারি ব্যাধ হরিণের পিছনে পিছনে সারা দিন ছুটে বেরিয়ে একটা হরিণও মারতে পারেনি। সন্ধেবেলায় গাছের তলায় বসে সে ভাবল কী খেতে দেবে ছেলেমেয়েদের? ধুলোর ভেতর বসে তাঁর বিষণ্ণ আঙুল কী লিখছিল? রাগ? প্রতিবাদ? কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? হরিণের বিরুদ্ধে? হরিণ তো প্রতীকমাত্র। একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়? থিয়োডর অডর্নো বলেছিলেন, ‘আউশভিত্‌সের পর আর কবিতা লেখা যায় না’। সে দিন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আকাশে মানবশরীর পোড়া ছাই দেখে তিনি অসহায় ভাবে ভেবেছিলেন, এর পরও কবিতা লেখা হবে? মাত্র সতেরো বছর আগে দিল্লিতে আমদাবাদের কবি কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘গুজরাতের পর আমি আর কবিতা লিখতে পারব না।’ ভারতবিখ্যাত কবি ও লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তি গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বললেন, ‘আমি ভারত ছেড়ে চলে যাব’। তাঁর বারান্দায় হিন্দু মৌলবাদীরা করাচির বিমানের টিকিট ফেলে রেখে গেলেন। কিছু দিন বাদে অসুস্থ অনন্তমূর্তি ভারত ছেড়ে গেলেন। করাচি নয়, আকাশের ও পারে বিরাট এক শহরে। শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা লেখক কালবুর্গি সকাল সাড়ে আটটায় স্ত্রীর সঙ্গে বসে ইডলি মুখে দিয়েছিলেন, বেল বাজল, দরজা খুলে দিলেন, তিনটে বুলেট তাঁকে শেষ করে দিল। সেই কর্নাটকে, সাংবাদিক, লেখক ও কবিকন্যা গৌরী লঙ্কেশ পড়ে রইলেন মুখ থুবড়ে। এই সে দিন, পেরুমল, এক নির্জন তামিল লেখক হিন্দু মৌলবাদীদের অত্যাচারে বিবিসি-কে বললেন, আমি আর লিখব না, লেখা ছেড়ে দিলাম।

Advertisement

রাষ্ট্রের সঙ্গে এক জন কবির কী সম্পর্ক হবে, সেটা প্লেটোর পৃথিবীবিখ্যাত হুমকি সত্ত্বেও আজও নির্ধারিত হয়নি। গত বছর গোয়া সাহিত্য উৎসবে সারা দেশের কবি-লেখকদের সামনে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ বললেন, মোদী-সরকার লেখক-বিরোধী সরকার। একটা মনন-বিরোধী হেজিমনি। আধিপত্য। প্রশ্ন হল অসহিষ্ণুতা। ওই কবিকে আমার পছন্দ নয়, ওর কবিতা পড়ে গা জ্বলে যায়, ওকে সরিয়ে দাও। তা হলে ওভিদ থেকে শুরু করে অ্যালেন গিন্সবার্গ পর্যন্ত কাউকেই তো পৃথিবীতে রাখা যায় না। কবিতার সঙ্গে রাষ্ট্রের যে উত্তরবিহীন প্রশ্নের সম্পর্ক, সেটা আছে বলেই তো কবিতা লেখা হয়, রাষ্ট্রের পরিকাঠামো পালটানো হয়। কবিতা শেষ পর্যন্ত শান্তি, ভালবাসার কথা বলে। কবিতা ভাঙনের জয়গান গায় যাতে গ়ড়ে ওঠে নতুন গড়ন।

আজ বিশ্ব কবিতা দিবস। ইউনেস্কো, কবিতার মতো প্রাচীনতম একটি শিল্পকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে একটা দিবস তৈরি করছেন, ধন্যবাদ। কবিতা লিখে কোনও কবির টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি হয় না। তবু এখনও শিকাগো কিংবা শিলিগুড়িতে তিরিশ জন তরুণ মধ্যরাতে মুখে কবিতা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। যেন তাঁরা আগুনের সন্তান। তাঁরা টাকা চান না, পয়সা চান না, যশ, সে-ও তো চঞ্চলা।

পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা লেখা হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়। সেই মহাকাব্যের নাম ‘গিলগামেশ’। মাত্র দেড়শো বছর আগে লোকে জানতে পেরেছে ভারতবর্ষ কবিতার সূতিকাঘর নয়, গ্রিস নয়, ওটা হবে মেসোপটেমিয়া। ‘উরাক’ নামে এক দেশের রাজার নাম গিলগামেশ। তিনি এক-তৃতীয়াংশ ভগবান। কিন্তু তাঁকে থামানোর জন্য স্বয়ং ভগবানই সৃষ্টি করলেন আর এক জনকে, তার নাম এনকিডু। প্রথমে সে ছিল বন্য, গায়ে বড় বড় লোম, তাকে পাঠানো হল এক সুন্দরী গণিকার কাছে, যে তাকে সভ্য করে গিলগামেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠাবে। কিন্তু ২০০৩ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাদের— সেই বছর প্রকাশিত হল অ্যান্ড্রু জর্জের একটি সক্ষম অনুবাদ ও টীকা। তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হল আধুনিক ভাষ্য— গিলগামেশ ঢুকে পড়ল ইরাক যুদ্ধে। তা হলে কবিতায় কোনও সাল লাগে না? দেশ লাগে না? উরাক হয়ে ওঠে ইরাক? শুভ আর অশুভ মুখোমুখি হবে, লড়াই হবে, যে ভাল তার জয় হবে, লোকে ভাল-কে বুকে করে রাখবে, খারাপকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। মেসোপটেমিয়া থেকে কাশ্মীর, ম্যাসিডোনিয়া থেকে কলকাতা, ইনকা থেকে তিব্বত— যত কবিতা লেখা হয়েছে, তার শিখরে দাঁড়িয়ে বিশ্ব কবিতা দিবস সেটাই কি বলতে চায়? ওগো নাটোরের বনলতা সেন, ওগো ইরাকের বনলতা সেন, ওগো সিরিয়ার বনলতা সেন, কবিতা আমাদের কাছে দু’দণ্ড শান্তি চেয়েছিল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement