সম্পাদকীয় ১

কৈফিয়ত

অঙ্কটি কত বড়? বর্তমান বাজেটে গ্রামোন্নয়ন খাতে মোট যত টাকা বরাদ্দ হইয়াছে, অঙ্কটি তাহার দ্বিগুণেরও বেশি। এই টাকা আকাশ হইতে পড়ে নাই, রাজকোষ হইতে তাহার ব্যবস্থা হইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:২২
Share:

মোদী সরব হইলে বেশি বিপজ্জনক, না কি নীরব, সেই বিষয়ে রঙ্গরসিকতা চলুক, ক্ষতি নাই। বরং, পান হইতে সুপারি খসিলেই যে-দেশে ভাবাবেগে আঘাত লাগে, সেখানে গণপরিসরে রসবোধ তৈরি হইলে ভালই। কিন্তু, রসিকতার একটি মস্ত দোষ, তাহা বিচার্য বিষয়ের গুরুত্বকে লঘু করিয়া দেয়। যেমন, সরব-নীরবের রসিকতায় ঢাকা পড়িয়া যাইতেছে যে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকে এই চুরিটিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের প্রতিটি নাগরিক। গত চার বৎসরে এই ব্যাংকটির মূলধনী খাতে পুনর্লগ্নির পরিমাণ দশ গুণেরও অধিক বাড়িয়া শেষ অবধি বর্তমান অর্থবর্ষে সা়ড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় ঠেকিয়াছে। দেশের সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মিলাইলে গত এগারো বৎসরে মূলধনী খাতে পুনর্লগ্নির পরিমাণ দুই লক্ষ ষাট হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

অঙ্কটি কত বড়? বর্তমান বাজেটে গ্রামোন্নয়ন খাতে মোট যত টাকা বরাদ্দ হইয়াছে, অঙ্কটি তাহার দ্বিগুণেরও বেশি। এই টাকা আকাশ হইতে পড়ে নাই, রাজকোষ হইতে তাহার ব্যবস্থা হইয়াছে। অর্থাৎ, কর বাবদ দেশের প্রতিটি নাগরিক সরকারের ঘরে যে টাকা জমা করিয়াছে, সেই টাকা। নীরব মোদী অথবা বিজয় মাল্যরা টাকা ধার শোধ না করিলে ব্যাংকের যে ক্ষতি হয়, সরকার রাজকোষের টাকায় তাহা পূরণ করিয়া চলিতেছে, এবং আরও ধার দেওয়ার রাস্তা খুলিতেছে। সেই টাকায়, যাহা ব্যাংকের গহ্বরে না গেলে এক শত দিনের কাজের প্রকল্পে আরও বহু মানুষের কর্মসংস্থান হইতে পারিত, বহু হাসপাতালের পরিকাঠামোর উন্নতি হইত, মিড-ডে মিলের বরাদ্দ ৪ টাকা তেরো পয়সায় আটকাইয়া থাকিত না। শিশু হইতে গুরুতর অসুস্থ, দরিদ্রতম মানুষ হইতে শিল্পের অপেক্ষায় বসিয়া থাকা যুবসম্প্রদায়, বহু কোটি মানুষকে বঞ্চিত করিয়া সরকার নীরব মোদীদের ঋণখেলাপির খেসারত দিয়াছে। বহু মানুষের রোজগারের টাকা হইতে কর বাবদ সরকারের হাতে যে টাকা তুলিয়া দিতেই হয়, সেই টাকায়। ইহা নিছক রসিকতার বিষয় হইতে পারে না।

বিশেষত, একটি গণতন্ত্রে। এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীরা দেশের মানুষের অছিমাত্র— তাঁহাদের একমাত্র কর্তব্য, সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা করা। এবং, কোনও ক্ষেত্রে যদি সেই স্বার্থ দৃশ্যত লঙ্ঘিত হয়, তবে দেশের মানুষের নিকট জবাবদিহি করা। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হইতে কোনও একটি সংস্থা সাড়ে এগারো হাজার কোটি টাকা চুরি করিলে সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানিবার অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের আছে। কেন এমনটা ঘটিতে পারিল, কাহারা দোষী, তাহাদের শাস্তির কী ব্যবস্থা হইতেছে, ভবিষ্যতে এই গোত্রের ঘটনা এড়াইবার জন্য কী ভাবা হইতেছে— দেশবাসীর নিকট সেই কৈফিয়ত দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই দায়কে কানাকড়িও মূল্য দেন নাই। চাপের মুখে পড়িয়া কিছু কিছু মন্ত্রী দায়সারা দুই-একটি কথা বলিয়াছেন, তাহাতে সরকারের দায়বোধহীন মনোভঙ্গি দ্বিগুণ প্রকট হইয়াছে। ব্যাংক ব্যবস্থার স্বাস্থ্য সম্পর্কে এত বড় প্রশ্ন উঠিল, অথচ অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট করিয়া কিছু বলিলেন না, টুইট-এ ক্ষান্ত হইলেন! আর মহানায়ক স্বয়ং? ভারত তাহার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে অ-মিতবাক হিসাবেই চেনে। এবং জানে, ক্ষমতায় আসিবার পূর্বে তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন, দিল্লীশ্বর হইলে তিনি চৌকিদারের দায়িত্ব পালন করিবেন— রাজকোষ হইতে যেন একটি নয়া পয়সা চুরি না হইতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিবেন। সরকারের প্রধান হিসাবে, এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতির সত্যরক্ষার স্বার্থে, দেশবাসীর নিকট জবাবদিহির দায়িত্বটি নরেন্দ্র মোদীর উপর বিশেষ ভাবে বর্তায়। তাঁহাকে জানাইতেই হইবে, এমন দিনে ডাকাতি হয় কীভাবে। রঙ্গরসিকতার ফাঁক গলিয়া প্রধানমন্ত্রী এই দায়িত্বটি এড়াইবার সুযোগ পাইলে গণতন্ত্রের অপূরণীয় ক্ষতি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement