নতুন মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
দিল্লি এখন নরেন্দ্র মোদীর কাছে নতুন শহর নয়। দু’বছর আগে যখন তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন দেশের বহু ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালস’ মোদীর বিরোধিতায় প্রবল ভাবে কার্যত রাজপথে নেমে পড়েছিলেন। ওইরকম একটা সময়ে কোনও একদিন নরেন্দ্র মোদী আমাকে বলেছিলেন, ‘‘আমি তো দেহাতি লোক। গুজরাত থেকে এসে প্রধানমন্ত্রী হলাম। অভিজাত রাজধানী দিল্লির বহু মানুষের এটা হজম হচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ এই অভিজাততন্ত্রের দাপটমুক্ত নয়। মোরারজি দেশাইয়ের মূত্র থেরাপি নিয়ে ব্যাঙ্গ হয়েছে। বল্লভভাই পটেলের ছোট ধুতি পড়া নিয়ে কম বিদ্রুপ হয়নি। ওঁরা প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। আমি তো অনেক ক্ষুদ্র মানুষ।’’
নরেন্দ্র মোদীর দিল্লি যে সম্পূর্ণ অচেনা ছিল তা তো নয়। তিনি অশোকা রোডে বিজেপির সদর দফতরের পিছনের কোয়ার্টার্সে দীর্ঘ সময় থেকেছেন, একটা ছোট্ট ঘরে। হরিয়ানা, হিমাচলের প্রভারী হয়েছে। কিন্তু সে দিনের নরেন্দ্র মোদী ও আজকের নরেন্দ্র মোদীও তো এক নয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী প্রথম সাংবাদিকদের সঙ্গে একান্তে দেখা করেন নিজের বাসভবনে নয়। দেখা করেন অরুণ জেটলির বাড়িতে। কৃষ্ণ মেনন মার্গে অরুণের বাসভবনে সে দিন যাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেখানে আমিও ছিলাম। কিন্তু যে সব সাংবাদিক নরেন্দ্র মোদীর ঘোরতর বিরোধী বলে পরিচয় দিয়ে তখন সাংবাদিকের থেকেও বেশি আন্দোলনকারী হয়ে উঠেছিলেন, অতিথি তালিকা থেকে তাঁদের সযত্নে পরিহার করা হয়েছিল। সেই নৈশভোজকে কেন্দ্র করে সাংবাদিক মহলে ঝড় ওঠে। কেন অমুককে ডাকা হয়েছে, কেন তমুককে ডাকা হয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি। অরুণ তখন সবে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছেন। ফলে কৌশল বদলে আরও কয়েক দফায় নানা ধরনের সাংবাদিকদের ডেকে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এটা বোঝা গিয়েছিল, এই রণকৌশলে হিতে বিপরীত হয়েছে। এখন দু’বছর পর আর অন্য কারও বাড়িতে নয়। এ বার মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের আগে প্রধানমন্ত্রীর নিজের বাড়িতেই কিছু সাংবাদিককে ডাকলেন। আবার যাঁরা তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তাঁদের না ডেকে একটা পাঁচমিশেলি গোষ্ঠী করে তাঁদের মুখোমুখি হলেন তিনি। অফ দ্য রেকর্ড নয়। কথা বললেন অনেকটাই অন দ্য রেকর্ড। দু’বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদীও দিল্লিকে অনেক বেশি বুঝতে শিখেছেন। আর তাই মন্ত্রিসভার এ বারের রদবদলে যাবতীয় কৌশল রচনার কাজটিও তিনি নিজে করেছেন। তিনি যদি কোম্পানির চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার হন, তা হলে চিফ অপারেশনস অফিসার হলেন অমিত শাহ। দু’বছর আগে তিনি অনেক কিছু অগ্রাহ্য করতেন। এখন করছেন না। হরিয়ানায় অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রী বসিয়ে নতুন পরীক্ষা করেছিলেন। এখন হরিয়ানায় নির্বাচন হলে সে কাজটি তিনি করতেন কি না, তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন, মহারাষ্ট্রে বৃদ্ধতন্ত্রকে হঠিয়ে নবীন মুখ্যমন্ত্রী করেছেন। জগদীশ ভগবতীর স্টাইলে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন। জাতপাতের সমীকরণকে অগ্রাহ্য করে প্রশাসনিক দক্ষতার ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা তৈরির কথা ভেবেছিলেন। এখন সেই নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পারছেন, জমিতে পা দিয়ে চলতে গেলে, দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে স্বয়ং ভগবানকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিলেও তাঁকে আপস করতে হবে এই ভারত নামক দেশটিতে। অতএব বয়সের সীমা যা-ই বেঁধে দেওয়া হোক না কেন, উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে প্রবীণ ব্রাহ্মণ নেতাকে সরানো যাবে না। তা লোকসভায় সদস্যসংখ্যা ২৮২ হোক না কেন।
আমদাবাদ থেকে এসে গুজরাত ভবনে আস্তানা গেড়ে যখন নরেন্দ্র মোদী প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তখন মোদীর কাছে নর্থ ব্লক সাউথ ব্লকের প্রশাসন ছিল অনেকটাই অপরিচিত। আমলাদের ব্যক্তিগত ভাবে অনেককেই চিনতেন না। তখন দিল্লির রাজনীতিটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহকর্মী অরুণ জেটলির হাত ধরেই কিন্তু করতে চেয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রকের পাশাপাশি তথ্যমন্ত্রকেরও দায়িত্ব অরুণকে দিয়ে তিনি ভেবেছিলেন সর্বভারতীয় অভিজাততন্ত্র এবং বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে অরুণ জেটলিকে সেতু করে সম্পর্ক স্থাপন করবেন। সর্বভারতীয় নাগরিক সমাজের কাছে গোধরার কলঙ্ক মুছে এক নতুন অধ্যায় শুরু করবেন। কিন্তু এই দু’বছর পর ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে বসে যে রদবদলটি মোদী করলেন সেটিতে মোহন ভাগবতের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া থাকলেও অন্য কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমনকী, জেটলিরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। নরেন্দ্র মোদী দু’বছরে নিজেকে অনেকটাই সুসংহত করে ফেলেছেন। রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, সবার উপরে লালকৃষ্ণ আডবাণীর ক্ষোভ-বিক্ষোভকে দু’বছরে অনেকটাই প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় কেউ নেই। আর তাই অর্থমন্ত্রকে অরুণ জেটলিকে অনেকটা স্বস্তি দিয়েছেন। জয়ন্ত সিনহার মতো ব্যক্তিত্বকে নর্থ ব্লক থেকে সরিয়ে অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকে প্রতিমন্ত্রী করে দিয়েছেন। জয়ন্ত সিনহা নিজে প্রাক্তন অথর্মন্ত্রী যশবন্ত সিনহার পুত্র। যে যশবন্ত সিনহার সঙ্গে সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর ছিল না। জয়ন্ত ম্যাকেঞ্জিতে কাজ করে আসা, তিনি রঘুরাম রাজনের বন্ধুও। অর্থমন্ত্রকে ক্রমশই তিনি হাই প্রোফাইল নেতা হয়ে অরুণের সমান্তরাল হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁকে সরিয়ে যাঁকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে, তার থেকেই বোঝা যায় অরুণের পক্ষে এর ফলে কাজ করাটা অনেক সহজ হবে। আবার বিমানমন্ত্রকের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অশোক গজপতি রাজু এনডিএ শরিক দলের (তেলুগু দেশমের) নেতা। তার নীচে সিনহাকে রাখায় প্রধানমন্ত্রীরও আবার বিমানমন্ত্রকে নজর রাখতে সুবিধা হবে।
অর্থমন্ত্রকে অরুণ জেটলিকে স্বস্তি দিলেও প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় মন্ত্রী পদ থেকে বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে সরিয়ে দিয়ে দিলেন অনন্ত কুমারকে। সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ কর্নাটকের ব্রাহ্মণ নেতা অনন্তকুমার ঘোরতর জেটলি বিরোধী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মূল্যায়ন— বেঙ্কাইয়া সংসদীয় মন্ত্রী হিসাবে অসফল। কিন্তু অনন্ত কুমার সফল হবেন। কারণ অনন্ত কুমার ছিলেন প্রমোদ মহাজনের চ্যালা। প্রমোদ মহাজন ঠিক যে ভাবে সংসদীয় মন্ত্রীর কাজ করেছেন সেটা অনন্ত কুমার তাঁর অধীনে প্রতিমন্ত্রী হয়ে অতীতে শিক্ষা নিয়েছিলেন। সব দলের নেতার সঙ্গে অনন্ত কুমারের বন্ধুত্ব সুবিদিত। আবার অরুণের তথ্যমন্ত্রক নিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার একটি কারণ হল অরুণ নিজেই তথ্যমন্ত্রক রাখতে চাইছিলেন না। বাজপেয়ী জমানায় তিনি এক বার তথ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। এবং তাঁর নিজের তথ্যমন্ত্রক সম্পর্কে সিনিক্যাল মত আছে। সেটা হল, ভগবানেরও সাধ্য নেই প্রসার ভারতীর সংস্কার করে। যেমন, এয়ার ইন্ডিয়া এবং বিএসএনএল-কে উদ্ধার করা কার্যত অসম্ভব। বেঙ্কাইয়া কোনও সর্বভারতীয় মুখ নন। অরুণের মতো দিল্লির মুখ নন। সংবাদপত্র্র মালিকদের বন্ধু বলেও পরিচিত নন। প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধি, এ হেন ব্যক্তি সরকার এবং সংবাদমাধ্যমের সেতু রচনার জন্য বেশি উপযুক্ত। আবার বেঙ্কাইয়ার কাছ থেকে নগরোন্নয়ন না নিয়ে বরং অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে তথ্যমন্ত্রক দেওয়ায় এক লহমায় বেঙ্কাইয়ার গুরুত্ব বেড়ে গেল। যেমন, দায়িত্ব বাড়ল প্রকাশ জাভরেকরের। পীযূষ গোয়েল এবং ধর্মেন্দ্র প্রধান আশা করলেও নাগপুর তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। প্রকাশ জাভরেকরকে স্মৃতি ইরানির বিকল্প হিসাবে বেছে নেওয়া হল। তাতে শিক্ষামন্ত্রকে আরএসএস-এর কর্মসূচি রূপায়ণে কোনও বাধা হবে না। বরং স্মৃতি ইরানির চেয়ে সফল ভাবে বেশি ঢাকঢোল না পিটিয়ে প্রকাশ্যে কাজটা করবেন বলে মনে করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তবে ইন্দিরা গাঁধী যে ভাবে কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের সরিয়ে দিতেন, তা কিন্তু নরেন্দ্র মোদী করেননি। ক্যাবিনেটের কাউকে সরাননি। যে পাঁচ জনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সকলেই প্রতিমন্ত্রী।
বেশ কিছু দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে তাঁকে বলেছিলাম, সাত নম্বর রেস কোর্স রোডে এসে আপনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে এত ময়ূর ডাকত না। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে কোনও পরিবর্তন হয়েছে? যদি মনে হয় তা হলে বলব, সেটা তোমার চোখের দোষ। তুমি চোখ পরীক্ষা করিয়ে নতুন চশমা নাও। আমার কোনও পরিবর্তন হবে না। আমি নরেন্দ্র মোদীই থাকব।’’
এ বারে মন্ত্রিসভার রদবদলের পর প্রধানমন্ত্রীকে দেখে মনে হচ্ছে, আজ তিনি অনেক বেশি সাবধানী। আগের মতো দুঃসাহসী নন।