জঙ্গলমহলের মানুষ স্রষ্টা এবং সৃষ্টির উপকরণও

এখানকার পাহাড়-পর্বত, বন, ডুংরি, গাছপালা—সব কিছুই সাদরে স্থান পেয়েছে এখানকার মানুষের গানে, গল্পে, কবিতায়, প্রবাদ প্রবচনে। আবার জঙ্গলমহলবাসীর জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক কাঠামো, উৎসব-পার্বণ নিয়ে লিখেছেন বহু সাহিত্যিক। লিখছেন বিধান মুখোপাধ্যায়এখানকার পাহাড়-পর্বত, বন, ডুংরি, গাছপালা—সব কিছুই সাদরে স্থান পেয়েছে এখানকার মানুষের গানে, গল্পে, কবিতায়, প্রবাদ প্রবচনে। আবার জঙ্গলমহলবাসীর জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক কাঠামো, উৎসব-পার্বণ নিয়ে লিখেছেন বহু সাহিত্যিক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০১:১১
Share:

ঝুমুর নাচের আসর। ছবি: সুজিত মাহাতো

জঙ্গলমহল নামটি এক দিনে তৈরি হয়নি। পিছনে রয়েছে লম্বা ইতিহাস। অনেকে জঙ্গলমহল বলতে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরকে চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই এই নামের তথ্যভিত্তিক পরিচয় পাওয়া যায়।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলার টুকরো অংশ নিয়ে এই জঙ্গলমহলের সৃষ্টি হয়েছে। শান্তি রক্ষা ও সুশাসনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি এক সময় জঙ্গলমহল নামের একটি পৃথক জেলা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। গবেষক জেসি ঝা-র ‘দ্য ভূমিজ রিভোল্ট’ বইয়ে এ তথ্যের উল্লেখ মেলে।

পৃথক জেলা তৈরি করতে গিয়ে বীরভূম জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হল পাঞ্চেত, বাঘমুণ্ডি, বেগুনকোদর, তরফ বালিয়াপার, কাতরাস, হেসলা (ঝালদা), ঝরিয়া, জয়পুর, মুকুন্দপুর, কিসমত নোয়াগড়, কিসমত চুটি, তোড়াংটুণ্ডি, নাগর কিয়ারি এবং পাতিকুমকে। বর্ধমান জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হল শনপাহাড়ি, ভঞ্জভূম, শেরগড় এবং বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর থেকে বিচ্ছিন্ন হল ছাতনা, বরাভূম, সুপুর, অম্বিকানগর, সিমলাপাল, ভেলাইডিহা। পুরাতন জঙ্গলমহলের সঙ্গে এই নূতন মহলগুলো জুড়ে দিয়ে এক বিস্তীর্ণ এলাকাকে নিয়ে গড়ে উঠল নতুন জেলা জঙ্গলমহল। বঙ্কিম মাহাতো তাঁর ‘ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য’ গ্রন্থেও এ কথা উল্লেখ করেছেন। এই জঙ্গলমহলকে তৎকালীন জয়েন্ট কমিশনার মিস্টার ডেন্ট ‘বাংলাভাষী অরণ্যরাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন।

Advertisement

এই অরণ্যবেষ্টিত, পাহাড়-পর্বত ঘেরা জঙ্গলমহলের জনসমাজের প্রতিচ্ছবি ও মানসিক বিকাশের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের সৃষ্ট শিল্প ও সাহিত্যচর্চায়। এখানকার সাহিত্য মূলত লোকসাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত। তবে উচ্চশ্রেণির সাহিত্য যে একেবারে নেই, তা নয়। অবশ্য তাঁদের জনজীবন, রুচি, ভাবধারা এবং সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে অনেক উপন্যাস, গল্প, নাটক প্রভৃতি উচ্চসাহিত্যাদর্শ গড়ে উঠেছে। এখানকার মানুষজনেরা একাধারে স্রষ্টা ও ক্লাসিক সাহিত্য সৃষ্টির উপকরণ। সারাদিন কঠিন পরিশ্রমের পরে সন্ধ্যাবেলায় তাঁদের সাহিত্য–শিল্পের আসর আয়োজন হয়। কোথাও গানের সুর, কোথাও গল্প-কথায়, প্রবাদ-প্রবচনে অরণ্য-জনতা সান্ধ্য অবসরটুকুকে উপভোগ্য করে তোলেন। এই সচলতা প্রাণাবেগে বিভিন্ন মানুষের স্মৃতিপথ বেয়ে লোকমুখে দেশ, কাল, পাত্র ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে।

এখানকার পাহাড়-পর্বত, বন, ডুংরি, গাছপালা—সব কিছুই সাদরে স্থান পেয়েছে এখানকার মানুষের গানে, গল্পে, কবিতায়, প্রবাদ প্রবচনে। জঙ্গলমহলের লোকসাহিত্য মূলত—ঝুমুর থেকে শুরু। তার পরে তা নানা বৈচিত্রে বিভিন্ন ঋতুর লোকসঙ্গীত, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে উৎসব-পার্বণের কথা বলতে শুরু করে। করম নাচ, জাওয়া নাচ, কাঠিনাচ, দাঁড়নাচ, পাতানাচ, ঝুমুর নাচ—সব নৃত্যসঙ্গীত এরই মধ্যে পড়ে। করম উৎসব অন্যতম শ্রেষ্ঠ শস্য উৎসব। নৃত্যগীত এর মূল অনুষঙ্গ। এই পরবে দু’টি করম ডালকে রাজা ও রানির প্রতীক হিসেবে ধরে পাশাপাশি পুঁতে পুজো করা হয়। করমরাজা সূর্য আর করমরাণি পৃথিবীর প্রতীক। ধামসা, মাদলের ব্যবহারে করম নাচের ও গানের যে সুর ভেসে ওঠে তা হল— ‘মহলের ভিতরে থাকি/ জানলায় নয়ন রাখি।/ আমি শুব জানলার গড়াতে/ খঁচা দিয়ে উঠাবে আমাকে’।

নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে এই শ্রেণির গান বাঁধা হয়ে থাকে। সরলতা, অকৃত্রিম মনের আবেগ প্রকাশে গানের শিল্পরূপ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এ ছাড়া, জাওয়া গীত, পাতা নাচ, টুসু, ভাদু—এ সব তো রয়েছেই। জীবন রস ও বৈভবই এর প্রধান সম্পদ। এ সব গানে শ্বশুরঘর, বাপেরবাড়ি সম্পর্কে নরনারীর জীবনের নানা দিক ফুটে ওঠে— ‘বাপের ঘরে ছিলম ভাল কাঁখে গাগরা চাল ভাজা/ শ্বশুর ঘরের বড় জ্বালা লক বুঝাতেই যায় বেলা’।

অনেক সময় বাদ, প্রতিবাদ, দ্বন্দ্ব সংঘাত প্রতিযোগিতা মূলক কথাবার্তা এই গানের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে থাকে। এর উৎকর্ষও চোখে পড়ার মতো। যেমন, ‘ভেলা গাছে হেলা ফেলা কত ভেলা ধর‍্যেছে/ অই মাগীরা গীত জানে না কত কলা ধর‍্যেছে’।

জঙ্গলমহলবাসীর জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক কাঠামো, উৎসব- পার্বণ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী থেকে শুরু করে সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, অমর মিত্র, কবি মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ চর্চা করে এসেছেন। শুধু তা-ই নয়, বহু বিষয়কে কেন্দ্র করে কবি হিসেবে উঠে এসেছেন দাশরথি মাহজি, পাতা মুর্মু, সাধন মাহাতোদের মতো মানুষেরা। এঁদের কবিতা, গল্প সমাজে যথেষ্ট আদৃত। কোনও কোনও কবিতায় জঙ্গলমহলের প্রকৃতি, জীবনাচরণ, হতাশা, বঞ্চনা, শোষণের কথা রয়েছে। কিন্তু সৌন্দর্যের ও নন্দন তত্ত্বের দিকটিও সহজেই আবিষ্কার করা যায়। কবি সাধন মাহাতো তাঁর ‘মহড়ার পালক’ কাব্যগ্রন্থে জনজীবনের অভাব-অনটনের দিকটি প্রকাশ করেছেন। ‘মারাংবুরু’ নামে পত্রিকাও এই অঞ্চলের অন্যতম আয়না। এ ছাড়া, হাতের কাজের নৈপুণ্য, বিশেষ করে টুসু, ভাদুর ‘চৌদল’ বানানো, পিঠে, কাঁথা নির্মাণের কাজে যে নকশা তৈরি করেন এই এলাকার মানুষেরা, তা থেকে সহজে চোখ ফেরানো যায় না।

জঙ্গলমহলের মানুষ তাঁদের স্বভাব সঙ্গত ভাবনাতেই তাঁদের ঐতিহ্য সমন্বিত শিল্প-সাহিত্যচর্চার দিকটি আজও অম্লান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্কট, জীবনের নানা প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের এই ভাবনা নিঃসন্দেহে গৌরবের। এঁরা যে মাটির কত কাছাকাছি, তা তাঁদের সৃষ্টির মধ্যেই ধরা পড়ে।

লেখক বাঁকুড়ার শালডিহা মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement