জলবৎ

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ০০:১৯
Share:

রবীন্দ্র সরোবরে ছট পূজা উপলক্ষে যাহা ঘটিল, তাহা দেখিয়া নাট্যশালা বলিলে কম বলা হইবে। কেবল কুনাট্য নহে, সেই ঘটনাবলি অতি নিম্নমানের কুনাট্য। জাতীয় পরিবেশ আদালত নির্দেশ দিয়াছিল, রবীন্দ্র সরোবরে কোনও পূজার অনুষ্ঠান করিতে দেওয়া চলিবে না। এই নির্দেশের পরে স্বাভাবিক অবস্থায় সেখানে পূজা হইবার কোনও কারণ ছিল না, কারণ আদালতের নির্দেশ শিরোধার্য। কিন্তু কী শবরীমালায়, কী কলিকাতায়, যাহা অস্বাভাবিক তাহাই স্বাভাবিক। আইন আইনের পথে চলে, বাস্তব তাহার আপন পথে। আর, কলিকাতায় তথা পশ্চিমবঙ্গে অধুনা সবার উপরে উৎসব সত্য, তাহার উপরে নাই। আদালতও নাই। দুর্গাপূজা হইতে শহিদ দিবস, রাজ্যের বারো মাসে ছাব্বিশ পার্বণের কোনওটিতেই মানুষের আনন্দের তুল্য আর কিছুর গুরুত্ব নাই। ছট পূজাই বা ব্যতিক্রম হইবে কেন? অতএব, যাহা ঘটিবার ছিল, তাহাই ঘটিয়াছে। রবীন্দ্র সরোবরে ছট পূজা হইয়াছে। মানুষের আনন্দকে অগ্রাধিকার দিয়া সরোবরের দরজা হাট করিয়া খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। প্রশাসন, পুলিশ, পুরসভা, রাজনীতিক, কেহই অবশ্য তাহার দায় স্বীকার করেন নাই। ‘অজ্ঞাতপরিচয়’দের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকিয়াছে পুলিশ— কিন্তু, যাহারা পুলিশের সম্মুখেই সরোবরে ঢুকিয়া যথেচ্ছাচার করিয়া গেল, তাহাদের পরিচয় ‘অজ্ঞাত’ থাকিল কোন যুক্তিতে, জানায় নাই। পুলিশের বক্তব্য, মহিলা এবং শিশুরা ঢুকিয়া পড়ায় তাহারা বাধা দিতে পারে নাই। ছট পূজায় যে মহিলারা থাকিবেনই, এই কথাটি বোধ করি পুলিশকর্তারা জানিতেন না, অথবা কাহারও নির্দেশে বিস্মৃত হইয়াছিলেন। ফলে, মহিলা পুলিশ মোতায়েন করা হয় নাই। স্থানীয় বিধায়ক এবং মন্ত্রী জানাইয়াছেন, আদালতের নির্দেশ রক্ষা করা তাঁহার কাজ নহে। পুরসভা জানাইয়াছে, সরোবরটি যে হেতু তাহাদের অধীন নহে, ফলে তাহাদের কোনও বক্তব্য নাই। কেএমডিএ কর্তৃপক্ষ নাকি থানায় অভিযোগ করিয়াছে। দশচক্রে ভগবান ভূত হইয়াই থাকেন।

Advertisement

রবীন্দ্র সরোবরই শুধু নহে, কলিকাতার অন্য প্রধান কৃত্রিম জলাধার সুভাষ সরোবরেও ছবিটি এক রকম। পাড়ায় পাড়ায় ছোট-বড় পুকুরও প্লাবিত হইয়াছে পূজার আবর্জনায়। এই জলাধারগুলির আদালতের রক্ষাকবচ নাই, কিন্তু বাস্তুতন্ত্র রক্ষার দাবি তাহাদেরও সমান। অবশ্য, যে প্রশাসন আদালতের আদেশকেই গ্রাহ্য করে না, তাহার নিকট বাস্তুতন্ত্র রক্ষার দায়িত্বজ্ঞান প্রত্যাশা করা বুঝি বিসর্জনের ডিজে-র নিকট নীরবতা আশা করিবার সমান। শব্দদৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করিবার আদালতের নির্দেশটিকেও উৎসবের মরসুমে অমান্য করিয়া চলাই দস্তুর হইল। ছট পূজাতেও দেদার শব্দবাজি ফাটিয়াছে। হাসপাতালের সম্মুখেই ফাটিয়াছে। অভিযোগ, পুলিশ দেখিয়াও দেখে নাই। অনুমান করা চলে, কর্তারা সমাজমাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থন করিবেন। কোনও অজুহাতেই যে কথাটি ঢাকা পড়িবে না, তাহা হইল, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন রাজ্যবাসীকে আইন ভাঙিবার ঢালাও ছা়ড়পত্র দিয়া রাখিয়াছে। রাস্তা আটকাইয়া পূজা করাই হউক, শব্দবাজি বা ডিজে ব্যবহারই হউক, বা আদালতের নির্দেশ অবজ্ঞা করিয়া রবীন্দ্র সরোবরে ছট পূজা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশাসনের অবাধ প্রশ্রয় মানুষকে সাহস জুগাইয়াছে। বলিয়াছে, সবার উপরে আনন্দ সত্য— যাহাতে মানুষের ‘আনন্দ’ হয়, তাহার সবই বৈধ। সেই বৈধতার সম্মুখে আদালতও গুরুত্বহীন, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অধিকারও তুচ্ছ। বাস্তুতন্ত্রের প্রশ্ন না তোলাই ভাল। যখন পাহাড় হাসিতেছে, জঙ্গলমহল হাসিতেছে, বাকি রাজ্যই বা হাসিবে না কেন? সেই হাসির দমকে না হয় প্রশাসনিকতার আব্রু উড়িয়াই গেল। যে হাসির টানে ভোট আসে, অন্তত আসিবার আশা জাগায়, প্রশাসনিক দায়িত্ব কি কখনও তাহার অধিক গুরুত্ব পাইতে পারে? নেতাদের রাজনীতি নাই?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement