হংকং-এ প্রতিবাদ এখন হইয়া উঠিয়াছে বৃহদ্বপু জনবিক্ষোভ। ফাইল চিত্র
ত্রিশ বৎসর পূর্বের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারকে মনে করাইয়া দিতেছে আজিকার হংকং। চিনা সরকারের অধীনে থাকা ভূখণ্ডে ছাত্রছাত্রী হইতে সরকারি চাকুরিজীবীরা পথে নামিয়াছেন, বিমানবন্দর ও জনপরিবহণ ধর্মঘটে স্তব্ধ হইয়াছে। তাঁহাদের প্রতিবাদ শুরু হইয়াছিল চিনা সরকারের একটি বিশেষ প্রত্যর্পণ আইনের বিরুদ্ধে, যাহার বলে হংকংয়ের যে কোনও নাগরিককে সন্দেহজনক মনে হইলে চিনে ফিরাইয়া আদালতে বিচার করিবার ক্ষমতা থাকিবে চিনা প্রশাসনের। এই প্রতিবাদ এখন হইয়া উঠিয়াছে বৃহদ্বপু জনবিক্ষোভ, নাগরিকরা হংকংয়ে গণতন্ত্র দাবি করিতেছেন, এমনকি চিনের হাত হইতে মুক্তিও। নাগরিক প্রতিবাদের সম্মুখে চিন হাত গুটাইয়া বসিয়া নাই, গত কিছু দিন যাবৎ হংকংয়ের রাজপথে দেখা যাইতেছে প্রচুর আধা সেনা। তাঁহাদের নিয়মিত মহড়া কেবল চিনের পেশি-প্রদর্শন নহে, হংকংয়ের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি— প্রতিবাদ ছাড়িয়া ভালয় ভালয় গৃহে না ফিরিলে ফল ভাল হইবে না। নাগরিক স্মৃতিপটে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের ছায়া ভাসিতেছে।
কিন্তু ইহা তো ১৯৮৯ নহে, ২০১৯। ত্রিশ বৎসরে বিশ্ব-রাজনীতির সমগ্র রূপরেখা পাল্টাইয়া গিয়াছে। সেনা-জুজু দেখাইয়া নাগরিককে পথে আনিবার পন্থায় চিনা প্রশাসনের অটল বিশ্বাস আজও থাকিতেই পারে, কিন্তু দমন-পীড়ন নীতির প্রয়োগে কোনও ভূখণ্ড বা তাহার অধিবাসীদের প্রশ্নাতীত আনুগত্যের দাবি অন্তত এই কালে ধোপে টিকিবার কথা নয়। কারণ এখন আর গোপনীয়তার আবরণে চরাচর মুড়িয়া যদৃচ্ছাচার করিবার উপায় নাই। এমনকি চিনেও। সংবাদমাধ্যম সতত প্রতীক্ষমাণ, সাধারণ মানুষ সমাজমাধ্যমের মাহাত্ম্যে অতিমাত্রায় তৎপর। ত্রিশ বৎসর পূর্বের চিন তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে গণহত্যার সংখ্যা চাপিয়া যাইতে পারিয়াছিল, আজিকার চিন পারিবে না। রাষ্ট্রগুলি, এবং মানুষও— আজ পরস্পর অনেক বেশি সংযুক্ত। অবশ্য বর্তমান বিশ্বে মন্দেরও অভাব নাই, দেশে দেশে ধর্ম-বর্ণ-জাতি লইয়া বিদ্বেষ চরমে, বিশ্ব-রাজনীতি বিপজ্জনক ভাবে দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকিয়াছে। তবু বিগত তিন দশকে একটিমাত্র উত্তরণের দৃষ্টান্তের কথা আসিলে এই রাষ্ট্রিক ও সামাজিক জীবনের প্রকাশ্যতার কথাই বলিতে হইবে। গড় নাগরিকের হাতে এখন অনেক বেশি তথ্য, তথ্যই তাঁহার হাতিয়ার। রক্তচক্ষু কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে তথ্যই তাঁহাকে জুঝিবার ক্ষমতা দেয়।
হংকংয়ের গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে চিন এরই মধ্যে ‘প্রায় সন্ত্রাস’ আখ্যা দিয়াছে। প্রতিবাদীদের বলা হইতেছে বিবেকহীন, হিংস্র অপরাধী। এই তথ্য ও সংবাদও প্রতিনিয়ত পৌঁছাইতেছে বিশ্বের দূরতম প্রান্তে। আমেরিকা চিনকে হুঁশিয়ারি দিতেছে, আবিশ্ব গণতান্ত্রিক স্বর নিন্দা ও প্রতিবাদে মুখর। অতীতে ধামাচাপা দিয়া অনায়াসে যে কার্যসিদ্ধি হইত, এখন তা হইতেছে না, এই সত্য চিনকে এক সঙ্কটের সম্মুখে দাঁড় করাইয়াছে। আমি আমার অধীন ভূখণ্ডে যাহা খুশি করিব, এই মদগর্বিতার দিন আর নাই। শুধু চিন বলিয়া নহে, যে যে স্থানে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রবল, সে সকল স্থানে এখন অতিরিক্ত এক দায় আসিয়া পড়িয়াছে। উদ্যত গণতান্ত্রিক অঙ্গুলির সম্মুখে জবাবদিহি করিবার দায়। তাহা এড়াইবার সাধ্য নাই।