ক ংগ্রেসের প্রবীণ নেতা এবং প্রদেশ কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি সোমেন্দ্রনাথ মিত্রের প্রয়াণে রাজ্য রাজনীতির একটি বড় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। ইতিহাসের নির্মোহ মূল্যায়নে এটি যুগপৎ গৌরবের আলো এবং কলঙ্কের কালিতে মাখা। কারণ সোমেনবাবু এক দিকে দক্ষ সংগঠক, কার্য উদ্ধারে কুশলী বলে স্বীকৃত হয়েছেন। অন্য দিকে বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ভাঙনকে অনিবার্য করে তুলে দলকে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু স্তরে পৌঁছে দেওয়ার পথটিও প্রশস্ত করে দিয়েছেন তিনিই। ফলে দুই নিরিখেই সোমেন মিত্রের অবস্থান বিচার করার অবকাশ রয়েছে।
জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোহরে। ছোটবেলায় কলকাতায় চলে আসা। মনোবিজ্ঞানে স্নাতক। আইন পাশও করেছিলেন। আমহার্স্ট স্ট্রিটে যৌথ পরিবারে তিনি ছিলেন ‘ছোড়দা’। ক্রমে পাড়ায়, চেনা গণ্ডিতে, এমনকি রাজনীতির ময়দানেও ‘ছোড়দা’ ডাকটিই সর্বজনীন হয়ে তাঁকে ‘কাছের মানুষ’ ভাবার চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। আরও ঘনিষ্ঠেরা তাঁকে ‘বড়বাবু’ও বলতেন। মমতা অবশ্য চিরদিনই পোশাকি নামে ‘সোমেনদা’ বলে সম্বোধন করেছেন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁর হাত ধরে শিয়ালদহ অঞ্চলে একটি বাহুবলী যুবশক্তির উত্থান ঘটেছিল। কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে সেই যুবকরা নকশাল আন্দোলনের মোকাবিলা করেছেন। ১৯৭২ বিধানসভা নির্বাচনে সোমেনবাবুকে কংগ্রেস অধুনালুপ্ত শিয়ালদহ বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করে। রাজ্যের সবচেয়ে ছোট এই কেন্দ্রে তিনি একটানা বিধায়ক ছিলেন ২০০৬ পর্যন্ত। এক বারই হারেন জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭-এ।
শিয়ালদহ-আমহার্স্ট স্ট্রিট অঞ্চলেই সোমেনবাবুর রাজনৈতিক বিচরণ ছিল অনেক স্বচ্ছন্দ। রাজ্য স্তরে তাঁর উত্তরণ ঘটে পরে, সাংগঠনিক দক্ষতায় সব জেলাতেই নিজস্ব গোষ্ঠীও তৈরি করে নেন তিনি। ১৯৭২-এ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মন্ত্রিত্বে সোমেন মিত্রকে বেছে নেননি। মন্ত্রী করেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও সুব্রত সেই সময় রাজ্যে কংগ্রেসের ছাত্র-যুব আন্দোলনে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।
সোমেনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে বরকত গনি খান চৌধুরীর ছত্রচ্ছায়ায়। রাজ্য কংগ্রেসে তখন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও গনি খানের দুই পৃথক শিবির। সুব্রতবাবু হয়ে যান প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠ। সোমেনবাবু আঁকড়ে ধরেন বরকতকে। সেই সম্পর্ক প্রায় পিতা-পুত্রের স্তরে পৌঁছেছিল। গনি খান আমৃত্যু সোমেনবাবুকে পাশে পেয়েছেন। তাঁর চেষ্টাতেই সোমেনবাবু প্রদেশ যুব কংগ্রেস সভাপতিও হন।
সোমেন মিত্রের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য: নিজের ‘টিম’কে সর্বদা আগলে রাখা, তাদের জন্য সুবিধা আদায় করে নেওয়া। নিজেই বলতেন, এ ক্ষেত্রে বরকত ছিলেন তাঁর দৃষ্টান্ত। তবে গোষ্ঠী-রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি কংগ্রেস হাই কম্যান্ডের বিরোধিতা করেছেন, দলের চরম সাংগঠনিক ক্ষতিরও কারণ হয়েছেন। নেতার পক্ষে যা নিতান্ত বেমানান।
সবচেয়ে নিদারুণ হল মমতাকে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুলে দেওয়া। রাজীব গাঁধী যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন মমতাকে তিনি রাজ্যে সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অগ্রাধিকার দিতেন। মমতার মাথায় সিপিএমের লাঠির ঘা পড়ার পরে কলকাতায় এসে রাজীব তাঁকে সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও করে দেন।
রাজীব-হত্যার পরে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের আমলে ১৯৯২-তে বাংলায় কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনে সভাপতি পদে মমতার সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সোমেনবাবুর। ভোট প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। কলকাতায় মহারাষ্ট্র নিবাস হলে রক্তক্ষয়ী মারামারিতে ভোটপর্ব সাঙ্গ হয়, সোমেনবাবু জেতেন মাত্র বাইশ ভোটের ব্যবধানে। বিজয়ীর মুকুটে কলঙ্কের কাঁটা নিয়ে তিনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন। দু’দফায় সে বার সভাপতি ছিলেন ’৯৮ পর্যন্ত। তবে এটাও ঠিক, ’৯৬-তে বিধানসভায় কংগ্রেস ৮২টি আসন পেয়েছিল।
১৯৯৮ লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি সীতারাম কেশরীকে ‘বুঝিয়ে’ কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাই কমিটি থেকে মমতাকে বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন সোমেন। রাজ্যে কংগ্রেসের কফিনে সেটাই ছিল অন্তিম পেরেক। ক্ষুব্ধ মমতা সোমেনবাবুর নেতৃত্বের কংগ্রেসকে ‘সিপিএমের দালাল’ বলে কংগ্রেস ছাড়েন। দলের মূল স্রোতও তাঁর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসে চলে যায়। বস্তুত সোমেনবাবুর হাত ধরে উঠে আসা অনেক কংগ্রেস নেতা আজ তৃণমূলে মন্ত্রী! (অন্য দিকে, লোকসভায় কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা অধীর চৌধুরীর উত্থানও তাঁর হাত ধরে।) আর কংগ্রেস সোমেনের কৌশলের মাশুল গুনে ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে!
প্রদেশ কংগ্রেসে প্রণববাবু যখন সভাপতি তখনও দলের হাই কমান্ডের ঘোষিত প্রার্থী দেবপ্রসাদ রায়ের বিরুদ্ধে তৃণমূল সমর্থিত জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে সমর্থন করে এক বার ফাটল ধরানোর কাজে সচেষ্ট হয়েছিলেন সোমেনবাবু। সেটা ২০০০ সাল। সনিয়া গাঁধী প্রকাশ্যে নিন্দা করেছিলেন তাঁর।
দলে কোণঠাসা হয়ে ২০০৯-এ সোমেনও কংগ্রেস ছেড়ে প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস গড়েন এবং অচিরে মমতার তৃণমূলে যোগ দেন। ‘মধুর প্রতিশোধ’! সোমেন মিত্রকে নিজের অধীনে পেয়ে মমতা তাঁকে ওই বছর লোকসভা ভোটে ডায়মন্ডহারবার থেকে জিতিয়ে আনেন। তত দিনে সোমেনবাবুর স্ত্রী তৃণমুলের বিধায়ক। কিন্তু আবার বিবাদে ২০১৩-তে সোমেন মিত্র সাংসদপদ ও তৃণমূল দুটিই ছাড়েন। কংগ্রেসে ফের তাঁর স্থান হয়।
সেখানে তাঁর শেষ চমকপ্রদ উত্তরণ ২০১৮’তে রাহুল গাঁধীর হাতে। অধীর চৌধুরীকে সরিয়ে কেন বৃদ্ধ সোমেনকে রাহুল বেছে নিয়েছিলেন, তা গবেষণাসাপেক্ষ।
তবে সেই সবই এ বার ইতিহাসের পাতায় চলে গেল। থেকে গেল আগামী দিনে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট বেঁধে ভোট লড়ার জন্য সোমেন মিত্রের অন্তিম প্রয়াসের রেখা।
ভাবীকাল তাঁকে কী ভাবে মনে রাখবে— কংগ্রেসে ভাঙনের কারিগর, না কি শিয়ালদহের ‘ছোড়দা’?