প্রত্যাশার ভারে ক্লান্ত শৈশব। ছবি: কৌশিক সাঁতরা
ডিপ্রেশনে’র বাংলা জানি। মন খারাপ!
একরত্তি মেয়েটির মনে যে এমন আঁধার করে মেঘ জমেছে, তা টের পায়নি কেউ। না বাবা, না মা! বন্ধুবান্ধবও না। সব সময় হাসিখুশি থাকা ওই মেয়েটাই যে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, বুঝতে পারেনি কেউ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন— আত্মহননকারীরা হয় একটু আড়াল খুঁজে নেয়, না হলে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যায়। সাধারণত এমনটাই দেখা যায়। দক্ষিণ কলকাতার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী কৃত্তিকা পাল বেছে নিয়েছিল দ্বিতীয় পথটি।
স্কুলের শৌচাগারে কৃত্তিকার দেহ উদ্ধারের পর আলোড়ন শুরু হয়েছে গোটা রাজ্যে। যে মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে সারাদিন ক্লাস করল, বাবা-মাকে পছন্দের খাবারের জোগাড় করে রাখতে বলল, সেই মেয়েই ‘সিক রুম’এ যাওয়ার নাম করে শৌচাগারে গিয়ে মুখে প্লাস্টিক জড়িয়ে হাতের শিরা কাটল! কেন এমন একটা চরম সিদ্ধান্ত নিল কৃত্তিকা? নানা জন বলছেন, নানা সম্ভাবনার কথা।
শৌচাগারে পড়ে থাকা তিন পাতার সুইসাইড নোটের যেটুকু পুলিশ সূত্র মারফত প্রকাশ্যে এসেছে, তা দেখে মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরা মোটামুটি একটা বিষয়ে নিশ্চিত— দীর্ঘদিন ধরে কৃত্তিকার মনের মধ্যে জমছিল অবসাদ। আর সেই অবসাদ সুকৌশলে লুকিয়ে রেখেছিল সে।
মন খারাপ মানে দূরে কোথাও মেঘ করেছে!
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলেই আসে অবসাদ। এটি এমন একটি সাধারণ মানসিক ভারসাম্যহীনতা, যা মানুষের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, ব্যবহার, সম্পর্ক, কর্মক্ষমতাকে গ্রাস করে। কখনও কখনও মানুষকে মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়। কোনও ঘটনায় সাময়িক ভাবে দুঃখ পাওয়া খুবই স্বাভাবিক! কিন্তু কোনও ভাবে যদি এই অনুভূতি অনেকদিন (দু’সপ্তাহের বেশি) ধরে চলে অথবা এই ঘটনা খুব ঘন ঘন ঘটে এবং তা যদি স্বাভাবিক জীবন ও স্বাস্থ্যকে ব্যাহত করে— তখন তাকে অবসাদের চিহ্ন রূপে ধরে, ব্যক্তির চিকিৎসা করা প্রয়োজন হয়।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, যে বা যিনি অবসাদগ্রস্ত, তিনি কি তাঁর সমস্যার কথা বুঝতে পারছেন? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, সে ক্ষেত্রে সমাধান সহজ। কারণ রোগী সচেতন হলে, চিকিৎসকদের কাজ সহজ হয়ে যায়। কিন্তু অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি যদি বুঝতে না পারেন, তা হলে সমস্যা জটিল আকার নেয়। কারণ— বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা ধরতেই পারেন না যে, তাঁর মনের মধ্যে ঘন হয়েছে নিম্নচাপ!
ডিপ্রেশনের বাংলা নাকি নিম্নচাপ?
গ্রাম হোক বা শহর, বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবারের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নিউক্লিয়ার পরিবারের মধ্যে ঘাটতি থাকে আনন্দের। বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করলে পরিবারের খুদে সদস্যদের মধ্যে তৈরি হয় একাকীত্ব! পরিবারের শূন্যতা ঢাকতে অপরিণত মন অনেক সময়ই জড়িয়ে পড়ে নানা সম্পর্কে। আর সেখান থেকে আঘাত এলে মন ডুবে যায় অবসাদে। অনেক সময় দেখা যায়, পারিবারিক হিংসা, যৌন-নিপীড়নের শিকার হয়ে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তমলুকের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অলোক পাত্র বলেন, ‘‘বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা দাদু, ঠাকুমা, কাকা-কাকিমা, খুড়তুতো ভাই-বোন এদের সান্নিধ্য কমই পায়। স্কুলে শিক্ষকদের কাছ থেকেও আগের মতো স্নেহ পায় না ছাত্র ছাত্রীরা। বর্তমান প্রজন্মের বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে পার্থিব বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। তাই এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা নিজেদের খুব একা ভাবতে শুরু করে।’’
চৌখশ তো হচ্ছে মেয়ে সকাল-সন্ধ্যাবেলা!
পুলিশ সূত্রে খবর, পড়াশোনায় বরাবরই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিল কৃত্তিকা। শিখত মার্শাল আর্টও। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সন্তানরা পড়াশোনায় ভাল হলে তার উপর তৈরি হয় অস্বাভাবিক চাপ। কখনও সে চাপ আসে পরিবারের কাছ থেকে, কখনও আত্মীয়স্বজন, কখনও আবার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। যদি প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারি, তা হলে কী হবে’— দিনরাত এই ভাবনা ঘিরে থাকে তাদের। ফলে কোনও পরীক্ষার ফল মনমতো না হলে অপরাধবোধে ভুগতে থাকে তারা। আর তা থেকেই নিয়ে ফেলে কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত।
আগে পড়াশোনার পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা মাঠে ময়দানে দাপিয়ে বেড়াত। মনোবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, শারীরিক কসরতে অনেক সময় অবসাদ দূর হয়ে যায়। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ কোথায়! স্কুল থেকে ফিরে হয় আঁকা, নয়তো নাচের ক্লাস। আর এ সব কিছু না থাকলে অ্যাবাকাস তো রয়েইছে।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে হাতে রাখা মোবাইলে বন্দি!
এখন প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হাতেই রয়েছে স্মার্টফোন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেখা যায় বহু কিশোর-কিশোরীকে। গবেষণা বলছে ইন্টারনেটে লাগাতার গেম খেললে বা ফেসবুক করলে মনের মধ্যে তৈরি হয় একাকীত্বের প্রতি আকর্ষণ। এ ছাড়া মোবাইল বা কম্পিউটার, ল্যাপটপে নানা ধরনের থ্রিলার, সিনেমা অথবা ওয়েব-সিরিজ কিশোর মনে জন্ম দেয় অভিনব সব ‘ভাবনা’। যেগুলি নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে চায় পড়ুয়ারা। যার পরিণতি অনেক সময় হয়ে ওঠে ভয়াবহ।
সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন— পরিবারগুলির মধ্যে যাতে সব সময় আনন্দের পরিবেশ বজায় থাকে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের যত্নশীল হতে হবে। বাবা-মাকে শিশু মনের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে। বন্ধুর মত মিশতে হবে তাদের সঙ্গে। যাতে তারা বাবা-মাকে মনের সব কথা খুলে বলে। পাশাপাশি আব্দার মেটানোর ক্ষেত্রেও রাখতে হবে ভারসাম্য। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অলোক পাত্রের মতে, ‘‘ছেলে মেয়েদের বাবা মা কোন কিছু চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন। তাই জীবনে প্রথমবার না পাওয়ার মুখোমুখি হলেই তৈরি হয় হতাশা। তাই বাবা মা’র উচিত সন্তানের চাওয়াগুলি প্রয়োজন অনুপাতে পূরণ করা।’’
পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল কোনও কাজে ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখতে পারলে, তার মধ্যে সহজে অবসাদ বাসা বাঁধতে পারে না। অস্থির মনকে স্থির করতে ধ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম! নিয়মিত ধ্যানের অভ্যাস করলে মানসিক অস্থিরতা দূর হয়। ছেলেমেয়েদের উৎসাহ বা আগ্রহের প্রতি নজর রেখে পাঠ্যক্রম নির্বাচন খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা উপযুক্ত শিক্ষক বা মনোবিদদের সাহায্য নিতে পারেন। তবে সবচেয়ে জরুরি হল, প্রতি পদক্ষেপে সন্তানের সঙ্গে থাকা! তাকে এটা বোঝানো যে, জয়-পরাজয় জীবনের অংশ। আর কোনও একটি ক্ষেত্রে একবার পরাজয়ে জীবন শেষ হয়ে যায় না!