ছবি: কুনাল বর্মণ
এত সুখ সহ্য হল না। তাই ধাক্কা দিয়েছেন তিনি। মানে, ভগবান। ২০১৪ সাল থেকে পরম স্নেহে ভারত ও তার অর্থব্যবস্থাকে তিনি ফুলে-ফলে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। হঠাৎ কী বেখেয়ালে কষে এক ধাক্কা। অবশ্য সৃষ্টি-ধ্বংস— এ সব তো ভগবানদেরই ‘ডোমেনের’ অংশ। পাপ-তাপে ভরা মন নিয়ে মর্তবাসীর তা জানার কথাও না। না, তবে কেউ কেউ তা জানতে পারেন নিশ্চয়ই। ভগবানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকলে এমন হয়!
যাই হোক, ভগবানের লীলায় ‘জিডিপি’ নামের এক অনামী অনামুখো দেশবাসীকে আশঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। সেটি নাকি তলানি থেকে নামতে নামতে একেবারে শূন্য ছাড়িয়ে গিয়েছে, এখন সঙ্কুচিত। যার মানে, দেশের মোট উৎপাদন কমেছে। তাতে কল-কারখানায় কাজ আর তেমন হচ্ছে না। লোকজনের চাকরিও যাচ্ছে। আরও যাবে বলে শোনা যাচ্ছে। মন্দার ধ্বনি চার দিকে। দেশজ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ রেটিং সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, ভারতে জিডিপির এমন সঙ্কোচন গোটা অর্থবছর (২০২০-২০২১) ধরে চলবে। যার অর্থ, সোজা বাংলায় আগামী দিন আরও ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
কতটা ভয়ঙ্কর? বিশেষজ্ঞেরা যা বলছেন, তা সত্যি হলে এর প্রভাব আপনার-আমার সকলের জীবনেই পড়তে পারে। এর আগে ৫-৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি নিয়েও বেকারির সমস্যায় যুঝেছে আমাদের দেশ। সেখানে বছরশেষে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ১০ শতাংশ হারে কমলে কী অবস্থা হতে পারে, তা অনুমান করাটা কঠিন নয়। ঠিক সেই আশঙ্কার কথাই বলছেন অর্থনীতিবিদেরা। কাজেই, নিয়মিত আয়, তা চাকরির মাইনে হোক বা ব্যবসার লাভ কিংবা বয়স্কদের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের সুদ থেকে আয়, যা-ই হোক না কেন, কেউ আর নিরাপদে নেই, এটাই মোদ্দা কথা।
তা হলে উপায়? এক তো দিনরাত ভগবানকে ডাকা যেতে পারে— ‘প্রভু আলোর পথ দেখাও’ বলে। কিংবা সব ‘বকোয়াস হ্যায়’ ভেবে দুধ থেকে সোনা ছেঁচে দেখতে পারেন। পেলে ভাল রোজগারের বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। কিংবা টিভিতে রিয়া চক্রবর্তী, সুশান্ত সিংহ রাজপুত, কঙ্গনা রানাওয়াত নিয়ে দিনভর আলোচনায় নিজেকে সমৃদ্ধ করুন। সামনে আবার রামমন্দির নির্মাণ নিয়েও ‘ব্যস্ত’ থাকতে হবে। আর পাকিস্তানের সঙ্গে এখন তো চিনও জুড়েছে। কথার যুদ্ধে এদের হারাতে কতক্ষণ? বাপ, চোদ্দো পুরুষের বদান্যতায় হাঁড়িতে চাল জোগানোর আর ফোনে ডেটা ভরানোর ব্যবস্থা পাকা থাকলে এই নিয়েই ব্যস্ত থাকুন। নইলে ভাবুন— কী হচ্ছে, কী হতে পারে, কঠিন অবস্থায় পড়লে কী করব?
জরুরি প্রয়োজন, চাহিদা আর সঞ্চয়— এই তিনটি বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞেরা এখন থেকেই নজর দিতে বলছেন। আজকের আয়ের কতটা এর কোথায় খরচ করব, সেটা ঠিক করাটা জরুরি। সরকারি তথ্য বলছে, ‘ভগবানের ধাক্কা’য় এ বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে ১.৮৯ কোটি লোক চাকরি খুইয়েছেন। অগস্টে সংখ্যাটা দু’কোটি ছাড়িয়েছে। চলতি অর্থবর্ষে এখনও ছ’মাসেরও বেশি বাকি। এই সংখ্যা কাকে, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কেউ জানেন না। থুড়ি, ভগবান বোধ হয় জানেন। তবে, তিনি তো কোনও দিনই ভবিষ্যৎ আগাম আমাদের জানাননি। কাজেই সেটার সুরক্ষার ভার যাঁর যাঁর নিজেকেই নিতে হবে।
তবে, খরচ কমিয়ে, ভবিষ্যতের সংস্থান করতে হবে— এই ভাবনার সঙ্গে কিন্তু মন্দার স্থায়িত্বের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমি-আপনি আর আমাদের মতো দেশের সবাই খরচ কমিয়ে দিলে মন্দা দীর্ঘায়িত হতে পারে। সেখানে বাজারে অর্থের জোগান দিয়ে যেতে হবে সরকারকে। কিন্তু তারও তো হাত-পা বাঁধা। জিএসটি থেকে আয় কমেছে বিপুল। হাতে রয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ধন, আর টাঁকশাল। টাঁকশালের মেশিন বেশি চালালে আবার দেশ জুড়ে মূল্যবৃদ্ধির ভয় আছে। কাজেই সরকারকেও অনেক মেপে, বুঝে এই ধাক্কা সামলাতে হবে।
একই কারণে সেই মাপজোক প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি সংসারেও হবে। হওয়া তো উচিত। এখন খরচ না কমালে সঙ্কটকালে সর্বনাশ হতে পারে। সেই চিন্তায় সঞ্চয় বাড়বে, তাতে আর ভুল কী! তবে সেটাও সরকারের কাছে শাপে বর হবে। আপনার-আমার জমানো অর্থ, সরকার খরচ করতে পারবে মন্দা পরিত্রাণে। তবে, সেটা ঠিক প্রজ্ঞা-মতো খরচ করাটাই সরকারের চ্যালেঞ্জ। অসহায় অতীতের এ নিয়ে অবশ্য অনেক প্রশ্ন রয়েছে।
তবে, অর্থের সংস্থান থাকলে আর বড় কোনও কিছু কেনার ভাবনা থাকলে এ সময় কিনে ফেলা যেতে পারে। বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট কেনা বা সংস্কার করা যেমন। এই সময়ে দরদাম করে কিনলে বা কাজ করিয়ে নিলে অনেকটা সাশ্রয় হবে অন্য সময়ের তুলনায়।
ইতিহাস বলছে, স্বাধীন ভারতে মন্দা তিন বার দেখা গিয়েছিল। ১৯৫৮, ১৯৬৬ আর ১৯৮০ সালে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনাবৃষ্টি, খরার ধাক্কায় কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া ছিল এর কারণ। সে সময় জাতীয় উৎপাদনের বড় অংশটাই আসত কৃষিক্ষেত্র থেকে। এ বার অবশ্য ভগবান কৃষিক্ষেত্রকে কৃপা করছেন। শিল্প, নির্মাণ, পর্যটন, পরিষেবা আরও নানা দিকে জিডিপির সঙ্কোচন হলেও একমাত্র বৃদ্ধির ছবি দেখা গিয়েছে কৃষিক্ষেত্রে। এ বছর ভাল বর্ষাও হয়েছে। সরকার জানিয়েছে এবং অনুমান করা যায়, কৃষিক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি (সিএসও-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে তা ৩.৪%) চলমান থাকবে। গভীর আঁধারে সেটাও বড় আশার কথা। উৎপাদন মার খাওয়ার জন্য অন্তত খাদ্যসঙ্কটে পড়তে হবে না দেশবাসীকে।
এখন আনলক-পর্ব শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে কাজের ক্ষেত্রগুলি খুলছে। ভাবতে ভুল নেই যে, দেশের অর্থব্যবস্থায় খারাপ সময়টা আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। এ বার আস্তে আস্তে তা শুধরে যাবে। আবার আমরা বৃদ্ধির পথে ফিরে যাব। তবে সেটা কত দিনে, তা নিয়ে নানা মত আছে। বিশেষজ্ঞদের কেউ বলছেন, চিন্তা নেই, যে গতিতে দেশের অর্থব্যবস্থা নীচে নেমেছে, সেই গতিতেই তা আবার চেগে উঠবে। আবার কারও কারও কথায়, এই ক্ষত সারাতে দু’থেকে পাঁচ বছর লাগতে পারে। দ্রুত শুধরে গেলে এক রকম। তা না হয়ে সময় বেশি নিলে, সমস্যা বাড়বে আপনার-আমার মতো সাধারণের।
এ কথা ঠিক, করোনার কারণে লকডাউন আর তাতে দেশ কেন সারা পৃথিবীর অর্থব্যবস্থায় ভাটার টান চলছে। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই দেখা যাবে, ভারতের অর্থব্যবস্থায় এমন ভাটা চলছে ২০১৬ সালের নোটবন্দির পর থেকেই। তার পর জিএসটি চালু হয়েছে দেশে। তা ভাল না মন্দ, কতটা নিখুঁত, সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, তার পরও দেশীয় অর্থনীতিতে জোয়ার আসেনি। আর এখন তো সব উড়ো খই করোনায় নমঃ। ‘গিন্নি’মার কথামতো ভগবানকেই আমরা ‘কেষ্টাব্যাটা’ ঠাউরেছি। অতএব, হাতে রইল সীমান্ত, চিন আর পাকিস্তান।