Coronavirus

করোনার কোপে মালিক-ভাড়াটে, ভাড়ার কী হবে!

কোনও কোনও পরিস্থিতি সকলকে একসঙ্গে প্রভাবিত করে। তাতে তৈরি হয় উভয় সঙ্কট। সেই সঙ্কটের সমাধান বার করা বেশ কঠিন। লকডাউনে একই সঙ্গে সমস্যায় পড়েছেন মেসের পড়ুয়া আর মালিকেরা। সমস্যার খোঁজে আনন্দবাজারএখনও যে কত নবীন প্রজন্ম মেসের বাসিন্দা। বিশ্বযুদ্ধের থেকেও ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মোকাবিলা করছেন তাঁরা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২০ ০৪:৪৩
Share:

মেদিনীপুরের এই রাস্তার উপর রয়েছে বেশ কয়েকটা মেস। নিজস্ব চিত্র

ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে হলে অনেক সময় ঘর ছাড়তে হয়। তখন ঘর হয়ে ওঠে মেসবাড়ি। বাংলার পড়াশোনা এবং সাহিত্য জগতের বহু স্বনামধন্যরা বেশ কিছু বছর মেসের বাসিন্দা ছিলেন। ফলে তাঁদের স্মৃতিচারণায় মেসবাড়ির জীবন, হাসি-কান্নার সাদা-কালো অনেকের জানা। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, কলকাতায় শরণার্থীদের আগমনের সময়ের ইতিহাস নানা ভাবেই ধরা। তৈরি হয়েছে মেসের বাসিন্দা কিছু কালজয়ী চরিত্রও। যেমন প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা।

Advertisement

কিন্তু সে সব তো বিখ্যাতদের জীবন। এখনও যে কত নবীন প্রজন্ম মেসের বাসিন্দা। বিশ্বযুদ্ধের থেকেও ভয়ঙ্কর সঙ্কটের মোকাবিলা করছেন তাঁরা। করোনাভাইরাসের বিশ্বজোড়া প্রকোপ এবং তাকে ঠেকাতে লকডাউন। এই পরিস্থিতিতে মেসকে কেন্দ্র করে সঙ্কটে পড়েছেন দু’ধরনের মানুষ। তাঁরা দু’টি পক্ষ। এক পক্ষ মেসের মালিক। আরেক পক্ষ পড়ুয়া। এছাড়াও রয়েছেন মেসে রান্না করে সংসারে সাহায্য করা কয়েকজন। সব কিছু বন্ধ থাকায় সঙ্কটে সকলেই। কোনও কোনও মেস মালিক ভাড়ার অর্থেই নির্ভরশীল। আবার কিছু পড়ুয়া টিউশন করেন। কারও বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। একপক্ষকে ভাড়া দিতে হবে। আরেক পক্ষকে ভাড়া নিতে হবে। উভয় সঙ্কট। আপাতত লকডাউন শেষ। ধাপে ধাপে তালা খুলছে। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ফের শহরের মেসে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন পড়ুয়ারা। এপ্রিল এবং মে, এই দু’মাস প্রায় কেউই মেসে ছিলেন না।

শহরের শরৎপল্লির এক মেসে থাকেন নীলাঞ্জন পাল। হিজলি কলেজের ছাত্র। বাড়ি নারায়ণগড়ে। নীলাঞ্জন বলছিলেন, ‘‘লকডাউন শুরু হওয়ার আগে বাড়ি চলে এসেছিলাম। এ বার মেসে ফিরব। মাসে এক হাজার টাকা ভাড়া। তিন মাস ভাড়া দেওয়া হয়নি। দু’মাস মেসে ছিলাম না। ওই দু’মাসের ভাড়া দিতে হবে কি না বুঝতে পারছি না। না দিতে হলেই ভাল হয়। একান্তই যদি দিতে হয়, তা হলে যেন ভাড়া কিছুটা মকুব করা হয়।’’ একই বক্তব্য বিএড পড়ুয়া অমিত মণ্ডলের। অমিতের কথায়, ‘‘ভাড়া মকুব করা হলে সুবিধা হয়।’’

Advertisement

মিরবাজারের এক মেসে থাকেন সৌমেন ঘোষ। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সৌমেন। বাড়ি দাঁতনে। সৌমেনও বলেন, ‘‘এই সময়ে অনেকেই আর্থিক সঙ্কটে রয়েছেন। মেস ভাড়া কিছুটা মকুব করা হলে অনেকেরই সুবিধা হয়।’’ শহরের মেসে থাকেন কলেজ ছাত্রী সঙ্গীতা ঘোষ। বাড়ি ঘাটালে। সঙ্গীতার কথায়, ‘‘মেসে তিন মাসের ভাড়া দেওয়া হয়নি। এর মধ্যে দু’মাস মেসে ছিলামই না। ওই দু’মাসের ভাড়া নেওয়া না হলেই সুবিধা হয়। না হলে খুব অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।’’

মেসে থেকে যাঁরা পড়াশোনা করেন তাঁদের একাংশ টিউশন করে খরচ চালান। লকডাউনে টিউশন বন্ধ ছিল। ফলে, তাঁদের সেই উপার্জনও হয়নি। মেদিনীপুরের বেশ কিছু পাড়া ‘মেসপাড়া’ বলে পরিচিত। যেমন রাঙামাটি, তাঁতিগেড়িয়া, অশোকনগর প্রভৃতি। এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম নেই। দুই মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এই শহরেই। রয়েছে মেদিনীপুর কলেজ, মেদিনীপুর কমার্স কলেজ, রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা কলেজ, আইন কলেজ, বিএড কলেজ প্রভৃতি। কয়েকটি হাইস্কুলও রয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একাংশ মেসে থাকেন। স্কুল পড়ুয়াদের একাংশও মেসে থাকে। মেসে থেকে পড়াশোনার খরচ খুব কম নয়। মেস ভাড়ার রকম ফের আছে। কোথাও মাসে ১,০০০-১,২০০ টাকা। কোথাও মাসে ৭০০-৮০০ টাকা। একটি ঘরে ৪-৬টি বেড থাকলে ভাড়া খানিক কম হয়। একটি ঘরে ২-৪টি বেড থাকলে ভাড়া খানিক বেশি হয়। এর উপরে রয়েছে খাওয়ার খরচ। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার খরচ। খাওয়ার খরচও মাসে কোথাও ১,২০০-১,৩০০ টাকা। কোথাও ১,৪০০-১,৬০০ টাকা। অনেক মেসেই রান্নার জন্য লোক রয়েছেন।

তবে মেস মালিকদের একাংশেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাঁদের উপার্জন মেস ভাড়াই। এক মেসের মালিক অতনু সাহা বলেন, ‘‘আমরা বাড়ির দোতলায় থাকি। একতলায় মেস। আমার ছোট ব্যবসা রয়েছে। মেস ভাড়ার উপর নির্ভর করেই সংসার চলে। মেসে যারা থাকত বাড়ি চলে গিয়েছে। এখনও ফেরেনি। আগে ফিরুক। কারও খুব অসুবিধা থাকলে তেমন হলে ভাড়া পরে পরে দেবে।’’

কাঁথিতে প্রভাতকুমার কলেজ এবং পলিটেকনিক কলেজের আশেপাশের এলাকায় শতাধিক বেসরকারি হস্টেল রয়েছে। লকডাউন শুরু হওয়ার পর অধিকাংশ পড়ুয়া বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তবে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি হস্টেলে হাতেগোনা কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া থেকে গিয়েছেন। সেখানকার এক হস্টেলের আবাসিক প্রীতম মণ্ডল বললেন, ‘‘১৫ কিলোমিটার দূরে বাড়ি হওয়ায় লকডাউন চলাকালীন কয়েকদিন চলে গিয়েছিলাম সেখানে। তবে ঝড়ের পরে গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় পড়াশোনার তাগিদে কাঁথি চলে এসেছি। যাঁরা থেকে গিয়েছিল তাঁরা নিজেদের উদ্যোগে রান্না করে দু’বেলা খাচ্ছেন।’’

মাস্টার ডিগ্রির পড়ুয়া প্রীতম মণ্ডলের বাবা খেতমজুর। লকডাউনে উপার্জন বন্ধ। তাই এপ্রিল এবং মে মাসে মেস ভাড়া দিতে পারেননি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয় বলে মালিককে জানিয়েছেন। একই রকম ভাবে কাঁথি শহরের ধনদিঘি এলাকার এক মেস মালিক তথা প্রধান শিক্ষক প্রীতিরঞ্জন মাইতি বলেন, ‘‘সকলেই চলে গিয়েছিল। তবে তিনজন পড়ুয়া এখনও রয়ে গিয়েছে। তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেব না বলে জানিয়েছি।’’

ঘাটাল শহরে মেয়েদের একটি হস্টেল রয়েছে। ঘাটাল কলেজের নিজস্ব হস্টেল সেটি। তবে বিক্ষিপ্ত ভাবে শহরে বেশ কয়েকটি মেসে বা বাড়ি ভাড়া নিয়ে অনেকে থাকেন। লকডাউন শুরু হতেই বেসরকারি মেসগুলি বন্ধ। খালি ভাড়া বাড়িগুলিও। ঘাটাল কলেজের উল্টোদিকেই একটি মেসে ১৯-২০ জন মেয়ে থাকতেন। তাঁদের কেউ স্কুল কলেজ পড়ুয়া। কেউ পড়েন নার্সিং। গত মার্চ থেকে ওই মেস বন্ধ। আবাসিকেরা বাড়ি চলে গিয়েছেন। ইতিমধ্যে অনেক ছাত্রী বলে দিয়েছেন, মেসে আর ফিরবেন না। তবে নার্সিং পড়ুয়াদের কয়েকজন থাকবেন। কবে থেকে থাকবেন তা অবশ্য জানানো হয়নি। ওই মেসের মালিক নন্দলাল ধাড়া বলছিলেন, ‘‘মেস এখন বন্ধ। কে কবে আসবে তা-ও ঠিক নেই। এটাই আমাদের একমাত্র জীবিকা ছিল।’’

ঘাটাল শহরে কুশপাতায় আরেকটি বাড়িতে বেশ কয়েকজন ছেলে একসঙ্গে ছিলেন। তাঁদের কেউ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। অনেকে আবার বেসরকারি সংস্থার কর্মী। লকডাউনে অনেক ঘর খালি। কুশপাতার ওই মালিকের আক্ষেপ, ‘‘তিন মাস হল বাড়ি খালি হয়ে পড়ে রয়েছে। এখন শুনছি একজনের চাকরি নেই। তাঁর কাছ থেকে তো আর বকেয়া ভাড়া চাওয়া যাবে না। একে ঘর খালি। তার উপর লোকসান।’’

উভয় সঙ্কটের সমাধান সহজে বার করা যায় না। তখন তুল্যমূল্য বিচারে মানবিকতার জয় দেখতে চান অনেকে।

তথ্য: বরুণ দে, কেশব মান্না, অভিজিৎ চক্রবর্তী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement