Domestic Violence

রাজনৈতিক দাবি

মেয়েদের সংগঠিত প্রতিবাদের ক্ষমতা কতখানি, তা-ও কি পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি? ধর্ষণের সংখ্যায় এ রাজ্য সর্বনিম্নের মধ্যে, কলকাতা এ বিষয়ে সেরা শহরগুলির একটি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:১৮
Share:

প্রতীকী ছবি।

মাথা ঠেকেছে আকাশে, কিন্তু পা আটকে রয়েছে কাদায়— ভারতে মেয়েদের ছবিটা যেন এমনই। প্রশাসন থেকে বৃহৎ বাণিজ্যিক সংস্থা, মহাকাশ থেকে অলিম্পিক স্টেডিয়াম, সর্বত্র শীর্ষে পা রেখেছেন তাঁরা। অথচ, বাড়িতে মারধর, অপমান থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন না মেয়েরা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর সাম্প্রতিক রিপোর্ট ফের দেখাল, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে নারী-হিংসার অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। এবং, মেয়েদের উপর আক্রমণের তিনটে ঘটনার একটা ঘটছে বাড়িতে। গার্হস্থ হিংসার অভিযোগ নিয়ে লক্ষাধিক মেয়ে প্রতি বছর পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছেন। শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ— গত বছর রাজ্যে প্রায় কুড়ি হাজার মেয়ে গার্হস্থ হিংসার অভিযোগ দায়ের করেছেন থানায়। সাধারণত, মারধর অসহনীয় হলে তবেই মেয়েরা থানা-পুলিশ করেন। অতএব এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বধূ-নির্যাতনকে, বিশেষত পণ আদায়ের উদ্দেশ্যে নিরপরাধ মেয়েদের মারধর করাকে, আজও ‘স্বাভাবিক’ বলে মনে করে সংসার, সমাজ। মাতাল স্বামীর হাতে বধূর প্রহারের চিত্র হুতোমের কলকাতা থেকে আজও কিছুমাত্র বদলায়নি। বাংলায় মেয়েদের শিক্ষার হার, রাজনীতিতে সক্রিয় যোগদান, নানা সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের হার অনেক রাজ্যের তুলনায় বেশি। তবু যে বাংলার মেয়েদের বিপন্নতা সর্বাধিক, তা বাঙালির রাজনীতির কেন্দ্রস্থিত ভণ্ডামিকে নির্দেশ করছে। বিপন্নের সক্ষমতা না বাড়িয়ে কেবল ক্ষমতাসীনের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষায় রাজনীতির সকল শক্তি ব্যয় হচ্ছে। পুরুষতন্ত্রের হিংস্রতাকে দমন করার, প্রতিহত করার কোনও চেষ্টাই দেখা যাচ্ছে না।

Advertisement

অনেকে দাবি করেছেন, বাঙালি মেয়েদের সক্ষমতা অধিক বলেই তাঁরা অভিযোগ লেখাচ্ছেন বেশি। অন্য রাজ্যে মেয়েরা মার খেয়ে চুপ করে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা পুলিশে যান। এই দাবির পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে, কিন্তু অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বাঙালির মেয়েদের সক্ষমতার ছবি খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। প্রথম তথ্যটি অবশ্যই নাবালিকা বিবাহ এবং অকাল-মাতৃত্বের, পশ্চিমবঙ্গ যার নিরিখে দেশে শীর্ষস্থানীয় রাজ্যগুলির অন্যতম। নাবালিকা পাচারেও পশ্চিমবঙ্গের স্থান ভীতিপ্রদ। এটা কিশোরী-তরুণীদের বিপন্নতাই নির্দেশ করে, সক্ষমতা বোঝায় না। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থান ও রোজগারের নিরিখেও বাঙালি মেয়েরা পিছিয়ে। মেয়েদের শ্রমশক্তিতে যোগদানের হার জাতীয় গড়েরও নীচে। অতএব স্বরোজগারের শক্তিও বাঙালি মেয়েদের আত্মপ্রত্যয় বাড়াচ্ছে না। সেই সঙ্গে, নারী আন্দোলনের যে ধারা আশি ও নব্বইয়ের দশকে নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে উদ্যোগী ছিল, বিপন্ন নারীর সহায়তায় সক্রিয় ছিল, তা-ও এখন অনেক স্তিমিত। পুলিশের প্রশিক্ষণ, প্রশাসনিক কর্মশালার সরকারি কর্মসূচিতে আবর্তিত হচ্ছে নারী সংগঠনগুলি। ফলে নির্যাতনের প্রতিরোধ-প্রতিবাদ মেয়েদের পক্ষে আরও কঠিন হয়ে উঠছে।

অথচ, মেয়েদের সংগঠিত প্রতিবাদের ক্ষমতা কতখানি, তা-ও কি পশ্চিমবঙ্গ দেখেনি? ধর্ষণের সংখ্যায় এ রাজ্য সর্বনিম্নের মধ্যে, কলকাতা এ বিষয়ে সেরা শহরগুলির একটি। হতে পারে, রাজনৈতিক কারণে ধর্ষণের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে পুলিশ। থানার বাইরে ‘মিটমাট’ করিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এখনও রয়েছে। কিন্তু ধর্ষণের উপেক্ষা বা ধর্ষকের সহায়তাকে সরকারের জন্য ‘বিপজ্জনক’ করে তুলেছে বাংলার জনআন্দোলনই। পার্ক স্ট্রিট-কামদুনির গণধর্ষণের রাজনৈতিক অভিঘাত তৃণমূল সরকার ভোলেনি। তাই ধর্ষণকে গুরুত্ব না দেওয়ার সাহস পুলিশ-প্রশাসনের নেই। গার্হস্থ হিংসার প্রতি সরকারের সহিষ্ণুতাকেও আঘাত করা দরকার। সাম্য ও সম্মানের দাবিকে রাজনৈতিক দাবি করে না তুললে নির্বিচার নিপীড়নের ছবি বদলাবে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement