প্রতীকী ছবি।
গৃহস্থকে সজাগ থাকিবার ঢক্কানিনাদ তুলিয়া তস্করকে উৎসাহ দান করিলে যাহা ঘটিতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন সেই রূপ হইতে চলিয়াছে। ভোট সংগ্রামে নারীসেনার আণুবীক্ষণিক উপস্থিতি এই সত্যকে প্রত্যেক বারের ন্যায় আবারও প্রতিষ্ঠা করিতে উদ্যত। দেশের স্বাধীনতা ‘দ্বিতীয় শৈশব’-এ পা রাখিলেও কেন্দ্রীয় আইনসভার ন্যায় রাজ্য আইনসভাগুলিতেও মহিলা সদস্যের সংখ্যা ‘প্রথম শৈশব’ অতিক্রম করিতে অক্ষমই রহিয়া গিয়াছে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন শাসন করিতে সক্ষম রাজনৈতিক দলগুলি ইতিমধ্যেই তাহাদের প্রার্থী-তালিকা এবং ইস্তাহার প্রকাশ করিয়াছে। প্রতিটি দল নিজ নিজ ঘোষণাপত্রে রীতিমতো ঘোষ-বর্ণে ‘নারী প্রগতি’র বিষয়টি উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে। কেহ নারীকে কর্মসংস্থান এবং নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়াছে। কেহ বিনা মাসুলে নারীশিক্ষাকে মাটি হইতে আকাশে তুলিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কেহ আবার ভাত ভুলিয়া ‘ভাতা’র কল নারী-নাসিকার অগ্রভাগে স্থাপন করিতে সচেষ্ট। অথচ, অধিকাংশ দলের প্রার্থী-তালিকায় নারী-প্রার্থীর সংখ্যা সাকুল্যে পনেরো শতাংশেও পৌঁছাইতে পারে নাই। এই রাজ্যের শাসক দলের প্রধান এক জন মহিলা। তৎসত্ত্বেও তাঁহাদের মহিলা-প্রার্থীর সংখ্যা কুড়ি শতাংশ অতিক্রম করিল না।
নির্বাচনের লাল ক্যানভাসে সম্প্রতি কতিপয় তরুণীর ঝকঝকে মুখমণ্ডল ভাস্বর হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু মঞ্চের উপর সামান্য কয়েকটি মুখের ঔজ্জ্বল্য সাজঘরের ধূসর শূন্যতাকে ঢাকিতে পারিবে না। নারীর জন্য যে নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ অঙ্কিত হইতেছে, তাহাও যথার্থ নহে। কারণ, তাহাকে প্রতিষ্ঠা দিবার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক পারঙ্গম হস্ত নাই। জীবনে ও যাপনে নারীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা প্রকাশের সূচক কদাপি কতিপয় মহিলা বৈমানিক বা মহাকাশচারী দ্বারা স্থিরীকৃত হওয়া সম্ভব নহে। ঘরের সম্মান এবং বাহিরের সাবলীলতা নিশ্চিত করিতে পারে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা। প্রাত্যহিক যাতায়াতের পথে, প্রতিটি দফতর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট সংখ্যক পরিচ্ছন্ন শৌচাগার ‘নারী স্বাধীনতা’কে যতখানি ভরসা জোগাইতে পারে, তাহা বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের নিশ্চয়তার চেয়ে কম কিছু নহে। সেই লক্ষ্যে অবতীর্ণ হইবার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রচনা করা এবং তীক্ষ্ণ যুক্তিতর্কে তাহার গুণাগুণ যাচাই করিয়া দেখিবার জন্য আইনসভায় শাসক এবং বিরোধী আসনে যথেষ্ট সংখ্যক নারী সদস্যের অবস্থান প্রয়োজন। অথচ, প্রার্থী-তালিকায় মহিলাদের নামসর্বস্ব উপস্থিতিই প্রমাণ, রাজনৈতিক দলগুলির তেমন সদিচ্ছা নাই। কারণ, দলগুলির কেন্দ্রীয় স্তরে নারীর অধিকারের দাবিতে মুখর হইবার জন্য যথেষ্ট মহিলা পরিচালক নাই।
ভারতীয় ‘গণতন্ত্র’ বৃদ্ধ হইয়াছে বটে, কিন্তু নিদ্রা যাইতে এখনও কিছু বাকি। নারীবাদের ‘গোলযোগ’ যদি তাহার কর্ণকুহরে একান্তই কষ্টকর ঠেকে, অন্তত মানবতাবাদের দোহাই মানিয়া আইনসভাতেও কিঞ্চিৎ গণতন্ত্র লইয়া আসা তাহার আশু কর্তব্য। ‘অর্ধেক আকাশ’ কেবল সাহিত্য ও স্লোগানের বিষয়বস্তু মাত্র নহে, রাজ্যের এবং দেশের অর্ধেক মানুষেরও উপাখ্যান।
শাসনের মহাকাব্যে সেই বাকি অর্ধেক আর কত কাল উপেক্ষিতা হইয়া থাকিবে?