পুরনো সংসদ ভবন। —ফাইল চিত্র।
স ংসদ ভবন থেকে সংবিধান সদন। আক্ষরিক অর্থেই এক কথায় নাম বদলে গেল। মঙ্গলবার শোভাযাত্রা সহকারে সংসদের নতুন বাড়ির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী সেন্ট্রাল হলের বক্তৃতায় পুরনো বাড়িটির নতুন নামকরণের প্রস্তাব দিলেন, সে দিনই সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রস্তাব কার্যকর করা হল। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই নামের মধ্য দিয়েই পুরনো ভবনটির মর্যাদা রক্ষার সুবন্দোবস্ত হল। হবেও বা। সংশয়ী নাগরিক অবশ্য প্রশ্ন তুলতে পারেন, সংবিধানটাই যদি পাল্টে দেওয়া হয়, তবে সংবিধান সদন সর্ব অর্থেই বিস্মৃত ইতিহাস হয়ে যাবে না তো? ‘বাস্তুশাস্ত্র’ অনুসরণে নির্মিত নতুন ঠিকানায় ‘শ্রী গণেশ’ করে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা, তার অভিঘাত আরও কত দূরে গিয়ে পৌঁছবে, ইন্ডিয়া তথা ভারতের জীবনতরী কোন কূলে গিয়ে ভিড়বে, সংবিধান সদন আপাতত সেই বিষয়ে জল্পনায় ব্রতী হতে পারে। তার হাতে তো এখন অনন্ত অবসর।
শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত বৃত্তাকার ইমারতটি অবশ্য প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলতে পারে, ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনার বিলাসিতায় তার কিছুমাত্র অভিরুচি নেই, বাস্তুশাস্ত্র নামক হিং টিং ছট নিয়েও সে মাথা ঘামাতে রাজি নয়, তার ভান্ডারে আছে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার ঐশ্বর্য, যত দিন বাঁচবে সেই অভিজ্ঞতা তার বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে থাকবে, প্রতি দিন সকালে সূর্যস্নাত হয়ে সে আপন ঐশ্বর্যের ভুবনে পরিভ্রমণ করবে, স্মরণ করবে স্বদেশের বর্ণময় জীবনবৃত্তান্ত। ১৯২৭ সালে ওই বাড়ির দ্বারোদ্ঘাটনের দুই দশক পরে সেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, পরবর্তী সাড়ে সাত দশক স্বাধীন সার্বভৌম দেশটির জনপ্রতিনিধিরা তার সভাকক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুশীলন করেছেন। গোটা পৃথিবী ছিল প্রথমে তার স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং পরে তার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার সশ্রদ্ধ সাক্ষী। সেই ইতিহাসের মর্যাদাময় প্রতীক সংবিধান সদন দৃপ্ত এবং শান্ত স্বরে বলতেই পারে: মোর লাগি করিয়ো না শোক।
অভিজ্ঞতা-ঋদ্ধ সংবিধান সদন বিলক্ষণ জানে, তার জীবনকাহিনি কোনও অপাপবিদ্ধ মসৃণ উত্তরণের বৃত্তান্ত নয়, সেই কাহিনির পরতে পরতে নিহিত আছে অনেক ব্যর্থতা, বিস্তর অপ্রাপ্তি, প্রভূত অনাচার। ভারতীয় গণতন্ত্রের বয়স যত বেড়েছে, তার সংসদীয় কর্মকাণ্ড তত পরিণত ও সার্থক হয়ে ওঠেনি, বরং উত্তরোত্তর তার মানের অবনতি হয়েছে, আইনসভার বিতর্ক ও আলোচনা ক্রমশই পরিণত হয়েছে ময়দানি কলহে এবং সংখ্যাগুরুত্বের আস্ফালনে। এই অবক্ষয় নিয়ে শতাব্দীর প্রথম দশকে লোকসভার অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গভীর আক্ষেপের স্মৃতি আজও স্থিতবুদ্ধি নাগরিকের মনে অমলিন। দুই দশক পরে সেই অবক্ষয় কেবল মাত্রায় বাড়েনি, তা এমন এক নতুন স্তরে পৌঁছেছে, যেখানে আলোচনা-নির্ভর গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তগুলিই আর বহাল নয়, যেখানে কর্তার ইচ্ছায় সমস্ত কর্ম সম্পন্ন হয়। নতুন সংসদ ভবন হয়তো জন্ম থেকেই এই নতুন ধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে— সংসদীয় গণতন্ত্রের মুক্ত, প্রশ্নময়, বিতর্কসমৃদ্ধ স্বরূপটি গোড়া থেকেই তার কাছে অচেনা, অজানা হয়ে থাকবে। এখানেই তার পূর্বসূরির প্রকৃত গৌরব, তার ইতিহাসের মৌলিক মহিমা। সেই ইতিহাসে কলঙ্ক বিস্তর, কিন্তু তার উপরে আছে গণতান্ত্রিক আদর্শ ও আচরণের প্রতি রাষ্ট্রনায়ক তথা রাজনীতিকদের আস্থার ঐতিহ্য, যে আস্থার প্রেরণায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক, প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং অবিসংবাদিত জননেতার মুখের উপর বিরোধী সাংসদরা নিয়মিত প্রবল প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন এবং তিনি নিয়মিত মনোযোগ সহকারে সেই প্রতিবাদ শোনেন ও তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন। তে হি নো দিবসা গতাঃ। অবসরপ্রাপ্ত সংসদ ভবনের নিস্তব্ধ অলিন্দে তাই মাঝে-মাঝে অস্ফুট দীর্ঘশ্বাসের আভাস মিলতেই পারে। হৃদয় যাঁদের কঠিন হয়ে গিয়েছে, তাঁরা অবশ্য সেই বার্তা শুনতে অক্ষম।