প্রতীকী ছবি।
অবশেষে শিক্ষকদের শূন্য পদ পূরণ হইবে। প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে কত দিনের মধ্যে কতগুলি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হইবে, তাহার নির্ধারিত সময়সীমাও ঘোষণা করিয়াছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইহা নিতান্ত প্রশাসনিক বিষয়, তবু যে নবান্ন হইতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে জানাইতে হইল, তাহাই ইঙ্গিত দিতেছে যে, বিষয়টি আজ রাজনৈতিক। হয়তো মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিতে চাহিয়াছেন যে, ২০১২ সাল হইতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে অব্যবস্থা চলিতেছে, যাহার প্রতিবাদে বারংবার আন্দোলনে নামিয়াছেন নিয়োগপ্রার্থীরা, তাহার পুনরাবৃত্তি হইবে না। আক্ষেপ, চব্বিশ ঘণ্টা না কাটিতেই বোঝা গেল, সহজে এই জটিল সমস্যার সমাধান হইবার নহে। প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের নূতন তালিকায় কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি স্থান পাইয়াছেন, যোগ্যতর প্রার্থী উপেক্ষিত হইয়াছেন, এই নালিশ ফের উঠিল। ইতিপূর্বে এমন নালিশ লইয়া বারংবার আদালতের শরণাপন্ন হইয়াছেন প্রার্থীরা। দীর্ঘ দিন মামলা চলিবার পরে দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করিতে আদালত নির্দেশ দিয়াছে। কিন্তু যে অস্বচ্ছতা নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দূষিত করিয়াছে, এখনও তাহা হইতে নিষ্কৃতি মেলে নাই। কেন এমন হইবে? স্বচ্ছ, ত্রুটিমুক্ত তালিকা নির্মাণের কাজটি কি এতই কঠিন? বহু বৎসর স্কুল সার্ভিস কমিশন এই কঠিন কাজটিই কি করিয়া আসে নাই? অথচ, গত দশ বৎসরে একের পর এক টেট পরীক্ষা হইয়াছে, তালিকা প্রস্তুত হইয়াছে, কিন্তু নিয়োগ হয় নাই।
এই অব্যবস্থা দ্রুত কাটাইয়া সুষ্ঠু নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন। রাজ্যের প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পঠন-পাঠন শিক্ষকের অভাবে কতটা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে, তাহা শূন্য পদের নিরিখে সহজেই অনুমেয়। মোট বত্রিশ হাজার শিক্ষকপদ শূন্য থাকিবার অর্থ, বহু শিক্ষক একাধিক শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের একত্র পড়াইয়াছেন, যাহা পাঠদানকে কেবল দেখাইবার বস্তু করিয়া তুলিয়াছে। শিক্ষার অধিকার আইন প্রণয়ন করিবার পরে এক দশক কাটিয়াছে, কিন্তু তাহাকে অর্থপূর্ণ করিবার মৌলিক শর্তগুলি পূরণ হয় নাই। রাজ্য রাজনীতিতে শিক্ষক নিয়োগ লইয়া যত বিতর্ক উঠিতেছে, শিক্ষা লইয়া অত নহে। তাহার কারণ বোঝা কঠিন নহে। সরকারি শিক্ষকের চাকুরি বহু তরুণ-তরুণীর নিকট পরম প্রার্থনীয়। তাহা নিয়মিত আয় এবং সামাজিক মর্যাদা আনিয়া দেয়। দলীয় রাজনীতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে মূলধন করিয়াই কারবার ফাঁদিয়া বসিতে চায়। নিয়োগের লোভ দেখাইয়া কখনও দলের প্রতি সমর্থন, নেতার প্রতি আনুগত্য দাবি করা হইয়াছে, কখনও আবার সরাসরি উৎকোচের দাবি করা হইয়াছে— এ রাজ্যে এমন অভিযোগ বারংবারই উঠিয়াছে। প্রার্থী তালিকার অস্বচ্ছতা সেই অভিযোগকেই আরও প্রতিষ্ঠা দিয়াছে। এই ক্ষোভকে অস্ত্র করিয়াছেন বিরোধীরা।
তবু সমস্যাটিকে কেবল স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির নিরিখে দেখিলে তাহার সম্পূর্ণ পরিধি ধরা পড়িবে না। কারণ, কেবলমাত্র শিক্ষক পদপ্রার্থীরাই নহেন, প্যারাটিচার, শিশু শিক্ষাকেন্দ্র এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষাকর্মী, শিক্ষার সহিত সংযুক্ত বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা অস্বচ্ছতা, অব্যবস্থার অভিযোগ আনিয়াছেন, এবং শিক্ষা দফতর তথা বিবিধ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা এবং অবহেলার প্রতিবাদে দীর্ঘ আন্দোলন করিয়াছেন। যে সকল কাজ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং কুশলতার দ্বারা সম্পন্ন হইবার কথা ছিল, সেগুলির জন্য জনসমাজ বারংবার আন্দোলিত হইয়াছে, আদালতের সময় ব্যয় হইয়াছে, এবং বহু পদপ্রার্থীরও জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হইয়াছে। সর্বোপরি, অগণিত ছাত্রছাত্রী যথাযথ পাঠ লাভ করিতে পারে নাই। এই সকল ক্ষতি অপূরণীয়। সুতরাং, অবিলম্বে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ নিয়োগ নিশ্চিত করিতে হইবে রাজ্য সরকারকে।