আট দফার দক্ষযজ্ঞ অবশেষে সমাপ্ত। কেবল অশান্তি, রক্তপাত, বোমা-গুলি, খুনজখমের উন্মত্ত তাণ্ডব নহে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া, বিশেষত, ভোট শুরুর পূর্ব হইতেই, নির্বাচনী প্রচারের নামে যে ভূতের নৃত্য দেখা গিয়াছে তাহা দেবাদিদেবের অনুচরদেরও লজ্জা দিতে পারে। সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক নিশ্চয় ভাবিতেছেন, গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান আয়োজনটিকে কেন্দ্র করিয়া এই রাজ্য এমন হিংস্র এবং কদর্য সংঘাতের নরকে নিক্ষিপ্ত হইল কেন? অন্যান্য রাজ্যের মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কেন এমন এক বিভীষিকায় পরিণত হইয়াছে, সেই পুরাতন প্রশ্নটি এই বার আরও প্রবল, আরও তীব্র আকারে রাজ্যবাসীর সম্মুখে আছড়াইয়া পড়িয়াছে। স্পষ্টতই, নির্বাচন এই বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতার সর্বাপেক্ষা অগ্নিগর্ভ উপলক্ষ হইতে পারে, কিন্তু ইহা কেবল ভোটপর্বের মরসুমি ব্যাধি নহে, রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসর সাধারণ ভাবেই এই ব্যাধিতে আক্রান্ত, বারো মাস চব্বিশ দিনই তাহার প্রকোপ নানা ভাবে দেখা যায়, ভোটের হাওয়ায় কেবল তাহার তেজ বহুগুণ বাড়ে।
অনেক সময়েই এমন একটি যুক্তি শোনা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে সর্ব ক্ষেত্রে এবং সর্ব স্তরে রাজনীতির অনুপ্রবেশই এই ব্যাধির কারণ। এই যুক্তিতে সমস্যা আছে। প্রথম কথা, রাজনীতির ‘অনুপ্রবেশ’ বলিয়া কিছু হয় না, যে কোনও সমাজে যে কোনও পরিসরেই রাজনীতি আছে, থাকিতে বাধ্য। সাধারণ ভাবে যাহাকে রাজনীতিহীনতা বলা হয় তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে স্থিতাবস্থাকে নির্বিবাদে মানিয়া লইয়া চলিবার নিষ্ক্রিয়তা, যেমন ‘রাজনীতিহীন’ পারিবারিক বলয়ে বহু নারী মুখ বুজিয়া পিতৃতন্ত্রের শাসন মানিয়া চলেন। এই দেশের গ্রামসমাজেও এমন নিষ্ক্রিয়তা বহু কাল জারি ছিল, আজও নানা অঞ্চলেই তাহা বহাল আছে। তাহা রাজনীতিহীনতা নহে, ক্ষমতার অচলায়তনকে অক্ষত রাখিবার রাজনীতি। অন্য দিকে, সমাজজীবনে সক্রিয় রাজনীতির প্রক্রিয়া জারি থাকিলেই তাহা হিংস্র সংঘর্ষের রূপ লইবে, এমন কোনও নিয়ম বা সূত্র নাই। দৃষ্টান্ত কেরল। সেই রাজ্যের সমাজে দীর্ঘ দিন যাবৎ রাজনীতির ব্যাপ্তি এবং গভীরতা দুইই বিপুল। কিন্তু তাহা এলাকার বা পাড়ার ক্ষমতা দখলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পর্যবসিত হয় নাই, অর্থনীতি ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের প্রতিযোগিতা সেই রাজনীতির মধ্য দিয়া সচল থাকিয়াছে। তাহার ফলে সেখানে সর্ব স্তরে রাজনীতির সঞ্চার গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই জোরদার করিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ বিপরীত পথে হাঁটিতে হাঁটিতে অনেক দূরে চলিয়া আসিয়াছে। অনেক নীচে।
উত্তরণ কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে রাজনীতির প্রবল ভূমিকার মধ্যেই উত্তরণের প্রথম এবং প্রধান সম্ভাবনা নিহিত রহিয়াছে। এই রাজ্যের সমাজ গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে তাহার সমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করে। তাহার একটি সহজ এবং স্পষ্ট প্রমাণ— অতিমারির বিপদ মাথায় করিয়াও অধিকাংশ এলাকায় ভোটদানের উচ্চ হার। গণতন্ত্রের অনুশীলনে আপন ভূমিকা পালনের এমন সর্বজনীন আগ্রহ কেবল হুজুগ বা দলনেতার প্রতি ভক্তির উন্মাদনা হইতে আসে না। মেয়েদের প্রবল উৎসাহে ভোটদানের ঘটনাও এই সত্যের এক বিশেষ প্রমাণ। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আপন গণতান্ত্রিক দায়িত্ব বোঝেন। সেই দায়িত্ব পালনের সুষ্ঠু পথটি তাঁহাদের সামনে খুলিয়া দিবার দায় রাজনৈতিক দলের নেতা ও নেত্রীদের, এবং বৃহত্তর সমাজের অগ্রণী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলির। সেখানেই বড় রকমের গোলযোগ ঘটিয়া গিয়াছে। সেই গোলযোগ এক দিনে দূর হইবার নহে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কুৎসিত দলতন্ত্রের কানাগলি হইতে সুস্থ গণতন্ত্রের রাজপথে আনিবার উদ্যোগ শুরু করা দরকার অবিলম্বে। এখনই তাহার প্রশস্ত লগ্ন।