বহু শহরে গণপরিবহণ বলতে ভরসা শুধুমাত্র অটোরিকশা। ফাইল চিত্র।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তাঁহার বাজেট-বক্তৃতায় নগরায়ণ প্রসঙ্গে এমন বাক্যবন্ধ উচ্চারণ করিয়াছেন, যাহার বঙ্গানুবাদ এই রূপ— শহরাঞ্চলগুলিকে সুস্থায়ী উন্নয়ন ও সকলের জন্য সুযোগের কেন্দ্র হিসাবে পুনঃকল্পনা করা প্রয়োজন। স্মরণকালের মধ্যে একঘেয়েতম বাজেট বক্তৃতায় এ-হেন একটি বাক্যবন্ধ ব্যতিক্রমী, সন্দেহ নাই। প্রশ্ন হইল, অর্থমন্ত্রী কথাগুলির অর্থ অনুধাবন করিয়া উচ্চারণ করিলেন কি? প্রথমে সকলের জন্য সুযোগের প্রসঙ্গটির কথাই ধরা যাউক। শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাসের খরচ অধিকতর হইবে, তাহা স্বাভাবিক। ফলে, দরিদ্রতর মানুষকে যদি শহরে কাজ করিতে হয়, তবে তাঁহাদের দূরবর্তী কোনও এলাকা হইতে প্রত্যহ শহরের কেন্দ্রে পৌঁছাইতে হইবে। অতএব, নগরায়ণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়া উচিত কম ব্যয়ের গণপরিবহণ। পরিবেশের কথা ভাবিলে, ‘সবুজ’ গণপরিবহণও বটে। ভারতে নূতনতর শহরগুলির দিকে তাকাইলেই স্পষ্ট হয়, তাহা মূলত ব্যক্তিগত গাড়ির কথা মাথায় রাখিয়াই তৈরি। বহু শহরে গণপরিবহণ বলিতে ভরসা শুধুমাত্র অটোরিকশা, যাহার ভাড়া স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাহিরে। সকলের জন্য সুযোগ তৈরির কথা ভাবিলে শহরতলি অঞ্চলের সহিত যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত করা যেমন জরুরি, তেমনই প্রয়োজন সেই শহরতলির ক্রমউন্নতিসাধনও, যাহাতে প্রতিটি প্রয়োজনেই মানুষকে শহরমুখী না হইতে হয়। ভারতের নগরায়ণের ইতিহাস সেই পথে হাঁটে নাই। ভবিষ্যৎ হাঁটিবে কি?
অন্য অনেক ক্ষেত্রের ন্যায় আবাসন ও নগর বিষয়ক মন্ত্রকের ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রীর যাবতীয় সদিচ্ছা মূলত মুখে সীমাবদ্ধ— টাকার অঙ্কে তাহার প্রতিফলন ঘটে নাই। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় এই বাজেটে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়িয়াছে সাড়ে তিন শতাংশ— মূল্যস্ফীতির হারটি বাদ দিলে, প্রকৃত বরাদ্দ কমিয়াছে। কিন্তু, অর্থমন্ত্রীর মুখের কথাগুলিও গভীরতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন, সুস্থায়ী উন্নয়ন। ভারতের নগর পরিকল্পনার সহিত সুস্থায়িত্বের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। যেমন, কিছু কাল পূর্বে জানা গিয়াছিল, ভারতের শহরগুলি ‘আরবান হিট ট্র্যাপ’ তৈরি করিতেছে। অর্থাৎ, এমন ভাবে শহর গড়িয়া উঠিয়াছে যে, ভূপৃষ্ঠ হইতে তাপ প্রতিফলিত হইয়া শূন্যে ফিরিতে পারিতেছে না, আটকা পড়িতেছে। পশ্চিমবঙ্গের নগরায়ণ প্রক্রিয়া এই ক্ষেত্রে আরও এক কাঠি সরেস। সরু রাস্তা হইতে অপ্রতুল নিকাশি, সবের সঙ্গেই নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, সুরক্ষা এবং পরিবেশগত সুস্থায়িত্বের প্রত্যক্ষ বিরোধ রহিয়াছে। অর্থমন্ত্রীর বরাদ্দবিহীন বাজেট ভাষণ এই ছবিটিকে বদলাইয়া দিতে পারিবে কি?
সর্বজনীন সুযোগ এবং সুস্থায়ী উন্নয়নের প্রশ্ন দুইটি এক বিশেষ বিন্দুতে আসিয়া মিশে— নগরের পরিসরে সাইকেল নামক দ্বিচক্রযানটির অধিকারে। বিশ্বের বহু শহর এই পরিবেশবান্ধব বাহনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেছে, সাইকেলের জন্য স্বতন্ত্র পথের ব্যবস্থা করিতেছে, শহরের কেন্দ্রস্থলে সাইকেলকেই প্রধান পরিবহণ হিসাবে বিবেচনা করিতেছে। ভারত বিপরীতপথগামী। ফলে, ভারতের নগর পরিকল্পনায় সাইকেলের গুরুত্ব নিতান্ত কম। কলিকাতাতেই যেমন। পথদুর্ঘটনায় কোনও সাইকেল আরোহীর মৃত্যু হইলে দিনকয়েক আলোচনা চলে যে, সত্যই সাইকেলের জন্য স্বতন্ত্র পথের প্রয়োজন— তাহার পর শহর নিজের ছন্দে ফিরিয়া যায়। অজুহাত শোনা যায়, এই শহরের অতিসঙ্কীর্ণ রাজপথ হইতে সাইকেলের জন্য জায়গা ছাড়া অসম্ভব। কিন্তু, কলিকাতার সংলগ্ন অঞ্চলের নূতন নগরায়ণ প্রক্রিয়াতেও সাইকেলের রাস্তা তৈরির প্রসঙ্গটি অবহেলিতই থাকে। সম্ভবত কর্তাদের ধারণায় সাইকেল মূলত গরিব মানুষের বাহন বলিয়াই। এই পরিস্থিতি পাল্টাইতে সত্যই পুনঃকল্পনার প্রয়োজন। কিন্তু, সেই সদিচ্ছা আছে কি?