প্রতীকী ছবি।
দুনিয়ায় একটিমাত্র বস্তুই ধ্রুব, তার নাম পরিবর্তন। এক বক্তৃতায় প্রথিতযশা অর্থশাস্ত্রী কৌশিক বসু মনে করিয়ে দিলেন, বিশেষত অতিমারির পর থেকে কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার যে ভাবে পাল্টাচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থাকেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টাতেই হবে। অতীতে বাজারে যে কাজ ছিল, সেগুলির বেশির ভাগই যেমন অদূর ভবিষ্যতে থাকবে না; তেমনই তৈরি হবে বহু নতুন গোত্রের কাজ, অতীত যা কল্পনাও করতে পারেনি। প্রশ্ন হল, শিক্ষাব্যবস্থার সেই পরিবর্তন কোন স্তরে ঘটা উচিত? উচ্চশিক্ষায় যদি হয়, ভারতের পক্ষে কাজটি তুলনায় সহজ— নেহরু-যুগের ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রটি এখনও বহুলাংশে বিশ্বমানের। কিন্তু, সেই পর্যায়ে মূলগত পরিবর্তন ঘটানো প্রথমত কঠিন; এবং দ্বিতীয়ত, যে হেতু বহু ছেলেমেয়ে সেই স্তরে পৌঁছোবার আগেই শিক্ষা থেকে বিযুক্ত হয়ে যায়, ফলে সেই পরিবর্তন ব্যাপক ফলদায়ী হতে পারে না। শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে একেবারে প্রাথমিক স্তরে। পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করিয়ে দেওয়ার যে পদ্ধতি এত দিন চলে এসেছে, তাকে আমূল পাল্টে ফেলতে হবে। প্রথম শ্রেণির ছাত্রকে কোডিং শেখানোর প্রয়োজন নেই, কিন্তু সে যা পড়ছে, তার সঙ্গে পরিপার্শ্বের সংযোগসূত্রগুলি ধরিয়ে দিতে হবে তাকে। শেখাতে হবে, কী ভাবে যুক্তি দিয়ে ধাপে ধাপে সমস্যার সমাধানে পৌঁছনো যায়, কী ভাবে পাঠ্যপুস্তক থেকে অধীত জ্ঞান প্রয়োগ করা যায় হাতেকলমে। এবং, শেখানোর পন্থাটিকে শিশুদের পক্ষে আনন্দময় করে তোলা জরুরি। শিক্ষাকে যদি সামাজিক চলমানতার বাহন করতে হয়, তবে প্রচলিত শিক্ষণপদ্ধতিকে আমূল বদলে ফেলা ছাড়া উপায়ান্তর নেই।
ভারতের বাস্তব এখানেই একটি দুরূহ সমস্যার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভারতের স্কুলশিক্ষা এখনও মূলত সরকারি স্কুলনির্ভর, এবং তার দুর্দশা সর্বজনবিদিত। স্কুলে শিক্ষকদের অনুপস্থিতির হার উদ্বেগজনক, পরিকাঠামো অতি সীমিত, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতও প্রয়োজনের তুলনায় বহু কম। সেই শিক্ষাব্যবস্থায় পুরনো পদ্ধতির পঠনপাঠনই নামমাত্র হয়। পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা বলছে যে, সরকারি স্কুলে সন্তানকে বিনা বেতনে পড়ানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকরা আর্থিক ক্ষমতা থাকলে— এমনকি, না থাকলেও— সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠাচ্ছেন। শিক্ষা ক্রমশই একটি ক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠছে— যাঁর আর্থিক সঙ্গতি আছে, তিনি সন্তানের জন্য সুশিক্ষা কিনতে পারছেন; যাঁর সেই সঙ্গতি নেই, তাঁর সন্তান উন্নত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রত্যাশা করা যায় কি?
অধ্যাপক বসু মনে করিয়ে দিলেন যে, শিক্ষা এমনই একটি বস্তু, যার বণ্টনে আর্থিক অসঙ্গতির প্রভাব কোনও কল্যাণরাষ্ট্রের পক্ষে অসহনীয়। অর্থাৎ, শিক্ষাক্ষেত্রে যদি পরিবর্তন আনতে হয়, তবে তাকে সর্বজনীন হতেই হবে— সরকারি স্কুলগুলি সেই পরিবর্তনের বাইরে থাকতে পারে না। কিন্তু, নতুন কৌশল রপ্ত করতে, এবং তাকে পাঠদানের প্রাত্যহিকতায় নিয়ে আসতে শিক্ষকদের একটি বড় অংশের অনীহাকে অতিক্রম করা যাবে কোন পদ্ধতিতে? শাস্তিদান তার প্রকৃষ্ট পন্থা হতে পারে না, কারণ শিক্ষককে শাস্তি দিলে তা শেষ অবধি ছাত্রছাত্রীদের শেখার সুযোগকে আরও সীমিত করে দেবে। তা হলে পন্থা কী? অধ্যাপক বসু দিল্লির সরকারি স্কুলের সাম্প্রতিক ভোলবদলের উদাহরণ দিয়ে বললেন যে, সরকারি স্তরে সদিচ্ছা থাকলে সত্যিই কাজ হয়। কিন্তু সেটাই কি পরিবর্তনের একমাত্র পথ? অধ্যাপক বসুর মতে, শিক্ষকদের মধ্যে যদি নিজেদের কাজ সম্বন্ধে গর্ববোধ তৈরি হয়, তা পাল্টে দিতে পারে অনেক কিছুই। তার জন্য শিক্ষকদের হৃত সামাজিক সম্মান পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। সেখানেই রাজনীতির বড় ভূমিকা।