বেআইনি ভাবে বাজি তৈরির এই ‘ট্র্যাডিশন’।
নবম শ্রেণির ছাত্র প্রদীপ সামন্তের স্মার্টফোন কেনার ইচ্ছা জেগেছিল। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, বাড়িতে ক্যানসার-আক্রান্ত পিতা, মা বিড়ি শ্রমিক— সাধ ও সাধ্যের বিস্তর ফারাক জুড়তে পুজোর ছুটিতে বাজি বাঁধার কাজে যোগ দিয়েছিল ছেলেটি। গত মঙ্গলবার পাঁশকুড়ার সাধুয়াপোতা-সহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম কেঁপে উঠল বিস্ফোরণে, একতলা পাকা বাড়িতে বাজি তৈরি চলছিল, বাড়িতেই মজুত ছিল বারুদ, বাজি তৈরির সরঞ্জাম, প্রচুর বাজি। বিস্ফোরণে পাকা বাড়ির সদর দরজার উপরের চাঙড় ভেঙে পড়েছে, আতঙ্কিত প্রতিবেশীরা বীভৎস দু’টি মৃত্যুদৃশ্যের সাক্ষী, মৃতদের এক জন প্রদীপ। দুর্ঘটনাস্থলে তার পায়ের ছিন্ন অংশ মেলে, দেহ উদ্ধার হয় কাছের পুকুর থেকে— এমনই ছিল বিস্ফোরণের তীব্রতা। বাড়ির মালিক স্বাভাবিক ভাবেই পলাতক, অথচ নিয়তির কী বিচিত্র পরিহাস, প্রদীপের পাশাপাশি বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন তারই স্ত্রী, বাজির কাজে সহায়িকা ছিলেন তিনিও।
বসতবাড়িতে বেআইনি ভাবে বাজি তৈরির এই ‘ট্র্যাডিশন’ পশ্চিমবঙ্গে সমানে চলেছে— প্রতি বছর ভবিতব্যের মতো এই দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মূল্যে তা স্বীকার করে নিতে হচ্ছে। প্রতি বছর একই ঘটনাক্রম: কালীপুজো ও দীপাবলির মুখে শব্দবাজি নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের নিয়মমাফিক তৎপরতা, কিছু ধরপাকড়, বাজি বাজেয়াপ্ত করা, পরিবেশবান্ধব ‘সবুজ’ বাজি নিয়ে অনতিপ্রবল প্রচারের সমান্তরালে সেই এক ঘটনা— গ্রামে মফস্সলে বসতবাড়ির আড়ালেই বাজি বাঁধা, চাম্পাহাটি কি পাঁশকুড়ায় কোনও প্রভেদ নেই। গ্রামবাসী সাধারণ মানুষ যার নাড়িনক্ষত্র জানেন, স্থানীয় প্রশাসন তা জানে না, এই ধারণা হাস্যকর। পুলিশ ‘চাইলে’ এই বেআইনি বাজি-ঠেকগুলির মালিকদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে পারে না, সেও কখনওই বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাজি বাঁধা এক জীবিকা, বহু মানুষের অন্নসংস্থানের উপায় বলেই তা চলতে দিতে হবে, এমনকি বেআইনি হলেও, ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় অমূল্য মানবপ্রাণ কেড়ে নিলেও— এই কি তবে অঘোষিত বার্তা?
আরও গুরুতর যে বিষয়টিতে অবিলম্বে নজর দেওয়া প্রয়োজন তা হল, বাজি বাঁধার কাজে নাবালকদের বাহুল্য। পশ্চিমবঙ্গ যেন এ ব্যাপারে নিতান্ত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে, গ্রামে মফস্সলে বাজি বাঁধায় বা মুখ্য সহায়তায় শ্রম দেবে প্রধানত অল্পবয়সি ছেলেরা। দারিদ্র বড় বালাই, দুঃস্থ পরিবারে কিছু অর্থ জোগাতে বা ব্যক্তিগত স্বপ্নপূরণের নেশায় টাকা রোজগার করতে কমবয়সি ছেলেরা বাজি বাঁধার কাজে যোগ দেয়। দক্ষ শ্রমিকদের নিলে মালিককে বেশি মজুরি দিতে হয়, তুলনায় শিশুশ্রমিকদের কাজ করিয়ে নেওয়া যায় অনেক কম টাকায়, এও এক বাস্তবসত্য। গত দু’বছরের অতিমারি দারিদ্রকে আরও ঘনীভূত করেছে, উপরন্তু যোগ হয়েছে ছাত্রদের স্কুলছুট হওয়ার প্রবণতা। সাধুয়াপোতায় প্রদীপের সঙ্গে আরও চার-পাঁচ জন নাবালক কাজ করত, এবং পড়ুয়াদের একাংশ যে বাজি তৈরির কাজে যুক্ত, প্রদীপের স্কুলের শিক্ষকেরা তা জানতেনই না! বৃহত্তর চিত্রটি তাই স্রেফ বেআইনি বাজি বাঁধার নয়; দারিদ্র, শিশুশ্রম, অতিমারি, স্কুলছুট সব কিছুর যোগসাজশে এক বিষাক্ত সমাজক্ষত। রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন তথা সরকার এই মুহূর্তে তার নিরাময়ে নজর দিক— অনভিজ্ঞের জীবন বাজি রেখে বাজি বাঁধার প্রয়োজন নির্মূল হোক।