টুলকিট বস্তুটি বড় বিষম ভাবিলে ভুল হইবে। ইহা বিশ্বের এক প্রান্তের আন্দোলনের সংবাদ গণমাধ্যমে ছড়াইয়া দিবার উপকরণ মাত্র। আপাতত তাহাতে দেশদ্রোহ ও চক্রান্তের বীজ খুঁজিয়া ফিরিতেছে ভারতীয় সরকার; গ্রেফতার হইয়াছেন দ্বাবিংশবর্ষীয়া পরিবেশ আন্দোলনকারী দিশা রবি। দিশা দলীয় রাজনীতির কর্মী নহেন, তাঁহার ক্রিয়াকলাপের কোনও বিন্দুতে নকশালবাদ বা সন্ত্রাসবাদ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, এমনকি চক্রান্ত-অন্বেষী সরকারও তাহা পায় নাই। কিন্তু এই তরুণী জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা নারীবাদের ন্যায় সামাজিক প্রশ্নগুলি লইয়া সচেতন ও কঠোর প্রতিবাদে বিশ্বাসী। অতএব, তিনি, প্রধানমন্ত্রীর মতে, ‘আন্দোলনজীবী’। আর, তরুণ ও আন্দোলনকারী পরিচয়টুকুই যে গ্রেফতার হইবার পক্ষে যথেষ্ট, নরেন্দ্র মোদীর ভারত তাহা প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। সংবাদে প্রকাশ, ৩ ফেব্রুয়ারি কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে যে টুলকিট টুইট করিয়াছিলেন পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, তাহা ‘শেয়ার’ করিয়াছিলেন দিশা। তাহাই অস্ত্র করিয়াছে দিল্লি পুলিশ, এবং আপনাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তত্ত্বের বাগাড়ম্বর হাজির করিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিগত সাড়ে ছয় বৎসর যাবৎ ভূতান্বেষণের— শত্রু বানাইবার— এই প্রক্রিয়া চলমান। শুধু ভাগ্যের পরিহাসটি লক্ষণীয়। যে কৃষকদের সহিত ইতিমধ্যেই এগারো দফা বৈঠক সারিয়াছে সরকার, ভবিষ্যতেও নাকি আলোচনা চালাইতে উৎসুক, তাঁহাদের প্রতিবাদের সংবাদ প্রচার করিলেই দেশদ্রোহী হইতে হইতেছে তরুণ ভারতীয় নাগরিককে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই মানসিকতাটিই দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করিতেছে। কৃষক বিক্ষোভের সূচনাপর্ব হইতেই নানা প্রকারে তাহাকে কালিমালিপ্ত করিবার প্রচেষ্টা চলিয়াছে, খলিস্তানি যোগ প্রমাণে অত্যুৎসাহ দেখা গিয়াছে। দিশার সহিতও খলিস্তানপন্থী গোষ্ঠীবর্গের যোগাযোগের সন্ধান চলিতেছে। নিরপেক্ষ তদন্তে নিষ্পত্তি হইতেই পারিত, কিন্তু ২৬ জানুয়ারি পরবর্তী এফআইআর-এর প্লাবনে ভরসা পাওয়া কঠিন। সমস্যা হইল, সরকারের সমালোচনা নিজ দায়িত্বে— দেশের যুবসমাজের নিকট এই বার্তা কি বাঞ্ছনীয়? সরকার যদি সকল ক্ষমতা ও শক্তি আন্দোলনকারীদের তাড়া করিতেই ব্যয় করিয়া ফেলে, তবে কৃষকদের ভীতি ও উদ্বেগ দূর হইবে কী প্রকারে?
ভারতীয় রাজনীতি মহলে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের তত্ত্ব নূতন নহে। ১৯৭০-এর দশকে দেশের অভ্যন্তরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘বিদেশি হাত’-এর কথা শোনা যাইত। কিন্তু যে কোনও নাগরিককেই যদি মত প্রকাশের অপরাধে এই ভাবে চক্রান্তকারী সাব্যস্ত করা হয়, তাহা এই তত্ত্বকে এক অদৃষ্টপূর্ব মাত্রায় উঠানোর শামিল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য যে, অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হইতেছে প্রতিবাদ, রাষ্ট্রবিরোধিতা হইতেছে ‘দেশদ্রোহ’, সরকার-বিরোধিতা হইতেছে ‘দেশবিরোধিতা’। সংসদে পাশ হওয়া আইনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ কী রূপে ও কত দূর হইবে, তাহা প্রশাসন লিখিয়া দিতে পারে না। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে ইতিপূর্বেও প্রশ্নগুলি উত্থাপিত হইয়াছে। কিন্তু যত বার নাগরিকের উপর অত্যাচার সহনশক্তির সীমা অতিক্রম করিবে, তত বারই বাক্স্বাধীনতার এই মৌলিক অধিকারটির কথা জোর দিয়া বলিতে হইবে। নান্যঃ পন্থাঃ।