Lok Sabha

বিপন্নতর

গত বছর যখন নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) আর চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপি-র সঙ্গে জোট বেঁধে এনডিএ সরকার তৈরি হয়েছিল, তখন বোঝা যায়নি দুই শরিকই কত বিরাট বাধ্যবাধকতার লাগামে আটকানো আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৩৯
Share:
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

গত সপ্তাহে পাশ হল ওয়াকফ বিল, যে ঘটনা ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে দুর্ভাগ্যময় হিসাবেই চিহ্নিত থাকবে। তার কারণ এই নয় যে ওয়াকফ বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ হল। কারণ— যে ভাবে এই হস্তক্ষেপ হল, তার প্রকার ও প্রকরণটি প্রকৃত গণতন্ত্রের অনেক রীতিই অমান্য করে। ওয়াকফের অন্তর্গত সম্পত্তির পরিমাণ নিয়ে উদ্বেগ সঙ্গত, ২০০৬ সালে সাচার রিপোর্টেও কিছু দুশ্চিন্তা ছিল ওয়াকফের দেখভাল ও ব্যয়বিধির ধরন নিয়ে। সমালোচনা হতে পারে, সংস্কারের জন্য আইনও পাশ হতে পারে। সমস্যা সেখানে নয়। যে ভাবে সম্পূর্ণ একপেশে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন পাশ হল, তা গণতান্ত্রিক দেশের দস্তুর হতে পারে না। দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ধর্ম-সংক্রান্ত কোনও বিষয় নিয়ে এত গুরুতর বিল এসেছে এবং পাশ হয়েছে এমন এক সময় যখন মন্ত্রিসভায় কিংবা শাসক দলের মধ্যে এক জনও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই। সংখ্যাগুরুবাদের স্বৈর মনোভাব এই ঘটনার মধ্যে নির্লজ্জ ভাবে প্রকট। কোনও নাগরিক বিতর্কের যাওয়ারও চেষ্টা দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলিতে এখন থেকে দুই জন করে অমুসলমান প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাবটিও বিস্ময় উদ্রেককারী। বিরোধী কংগ্রেস এর তীব্র সমালোচনা করেছে, যার উত্তরে বিজেপির বক্তব্যটি চিত্তাকর্ষক, মনোহারী— ‘ইনক্লুসিভিটি’ বা সকলকে নিয়ে চলার লক্ষ্যেই নাকি এই সিদ্ধান্ত। সকলকে নিয়ে চলা? মুসলমান সমাজ বিষয়ে একটি গোটা আইন পাশ হয়ে গেল তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে, সেখানে ‘ইনক্লুসিভিটি’-র প্রশ্ন ওঠেই বা কী করে। অথচ ভারতের বিরোধী শক্তি এখন এতই অবল, অশক্ত ও অকার্যকর, এবং অর্থ ক্ষমতা প্রতিপত্তির সার্বিক সম্মিলনে শাসক শক্তি এমনই দুর্দমনীয় যে, সংসদে এই সব প্রশ্নোত্তরই শেষ পর্যন্ত সময় কাটানোর অছিলা মাত্র।

Advertisement

বিস্মিত করে শাসকের জোটসঙ্গী দলগুলিও। গত বছর যখন নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ) আর চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপি-র সঙ্গে জোট বেঁধে এনডিএ সরকার তৈরি হয়েছিল, তখন বোঝা যায়নি দুই শরিকই কত বিরাট বাধ্যবাধকতার লাগামে আটকানো আছে। লাগামের রাশ রয়েছে বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের হাতে, যাঁরা শরিকদের যেমন খুশি নাচাতে পারেন। টিডিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তাঁরা যে সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেগুলি মেনে নেওয়ার ফলে তাঁদের দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই। তথ্য জানানোর সময়সীমা, ওয়াকফ বোর্ডে রাজ্য সরকারের আংশিক ভূমিকা ইত্যাদি খুঁটিনাটি পদ্ধতিগত সংশোধনী ছাড়া আর কোনও ‘বক্তব্য’ই যে তাঁদের ছিল না, শুনে তাজ্জব মানতে হয়। নিজেদের রাজ্যের মুসলমান জনসমাজের মতামতের উপর গুরুত্ব দেওয়ার ‘চাপ’ও তাঁদের উপর নেই, বোঝা গেল। সংখ্যাগুরুবাদের জোয়ার ইতিমধ্যে সে সব রাজ্যেও অন্য সব মতামতকে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে। সঙ্গে যদি মুসলমানদের জন্য উন্নয়ন ইত্যাদি কতিপয় তাস তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন, তা হলে এ কুল ও কুল দুই-ই রাখার বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

যে বিষয়টি সম্পূর্ণ ঊহ্য থেকে গেল, তা সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন। বস্তুত, মুসলমান সমাজের বিবিধ রীতিনীতি সংস্কারের মতো ওয়াকফ সম্পত্তির ধারণাটির মধ্যেও বহু দশক যাবৎ সামাজিক বৈষম্য নামক সমস্যার মীমাংসার বিস্তর অবকাশ ছিল। যদিও ধর্মীয় ধারণা হিসেবেই এর পরিচয়, সামাজিক ন্যায়ের প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে ওয়াকফ বিতর্ক অর্থহীন। অথচ এই বিল আলোচনার সময়ে বিষয়টি পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হল, ঠিক যেমন মুসলমান সমাজ ও ওবিসি সংরক্ষণ প্রশ্নেও ধর্মসংক্রান্ত খুঁটিনাটির মধ্যে ঢুকে সামাজিক ন্যায়ের মৌলিক চিন্তাটি সাম্প্রতিক বিতর্কের মধ্যে অনেকাংশে হারিয়ে গেল। ফলে, ওয়াকফ আইনটি যে প্রকারে ও আকারে পাশ হল, গণতান্ত্রিক ভারতের সংখ্যালঘু সমাজ তাতে স্পষ্টতই বিপন্নতর হল। অথবা, তাকে বিপন্নতর করা হল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement